আমার প্রথম পক্ষের শাশুড়ি কয়েক বছর যাবত অসুস্থতায় ভুগে সোমবার থেকে জবান বন্ধ। এখন তিনি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন।
লোক মারফত খবর পাঠিয়েছেন,আমাকে নাকি তিনি শেষ দেখা দেখতে চান। আমি আমার দুই ছেলেকে নিয়ে আজ আমার প্রাক্তন স্বামীর বাড়িতে বিশ বছর পর পা রাখলাম। টের পাচ্ছি,সময়ের চেয়ে বড় শক্তি পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয়টি আর নেই!
বিশ বছর আগে এ বাড়ির উঠোন শেষ বার ডিঙ্গিয়ে যাবার সময় স্বামী পরিত্যক্তা যে নারী চোখের জলে না হলেও দুঃখ আর অপমানের নোনা জলে বুকের মাঝে অষ্টম মহাসাগর গড়েছিল আজ সেই নারীর বুকে কোন নোনা জলের অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল সুখের দক্ষিণ হাওয়া!
আর সেই দক্ষিণ হাওয়ার দুই সারথী আমার দুই সন্তান। তাদের হাত ধরেই সেই পরিত্যক্ত উঠোন ডিঙ্গিয়ে সেই দোচালা টিনের ঘরের দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
টের পাচ্ছি,আমার বুকের মহাসাগরের মতোই বদলে গেছে এ বাড়ির অনেক কিছু!
উঠোনের পূর্ব দিকে সেই চালতা গাছটা আর নেই।
পুকুরে নতুন শান বাঁধানো ঘাট , এবাড়ির জৌলুস বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ !
পুকুরের পাশে যে শিউলি ফুলের গাছটা ছিল তা অবশ্য এখনো চোখে পড়েনি, সে গাছটি কি আছে নাকি আমার মতোই এ বাড়ির মাটি ত্যাগ করেছে ,জানা নাই!
তবে ঘরটা ঠিক আগের মতোই আছে। চৌকাঠের তৈরী দোতলা বড় টিনের ঘর, বৈঠক খানার সামনে চওড়া একফালি দাওয়া!
আমি সেই দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরের দিকে চেয়ে দেখি ,একদা সিংহের মতো গর্জন করা প্রাক্তন শাশুড়ি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। তার শরীরের সেই পাহাড়ের মতো দ্রীপ্ততা আর নেই! চোখে মুখের সেই ক্ষিপ্রতাও সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে!
তিনি মুখে কোন কথা বলতে পারছেন না তবে হাত নেড়ে ইশারায় আমাকে তার কাছে যেতে বললেন। আমার পা দুটো কিছুতেই সামনে এগিয়ে নিতে পারছি না, আতীতের সমস্ত কটূক্তি গুলো যেন অক্টোপাসের মতো আমার পা দুটোকে মাটির সাথে আঁকড়ে ধরে আছে। আমি ঠোঁটে মুচকি হাসি দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুখন যেতে না যেতেই এক ত্রিশ-চল্লিশ বছরের নারী এসে আমাকে ঘরের ভিতরে যেতে বললেন।
আমি তার দিকে না তাকিয়েই দুই ছেলে সুমন আর সজীবের হাত ধরে দাওয়া ডিঙ্গিয়ে এককালের অভিশপ্ত সেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
আমাদের বসার জন্য ঐ নারী তিনটি চেয়ার এগিয়ে দিলেন।
আমি এইবার ঐ নারীর মুখের দিকে তাকালাম,
নাহ্! চিনতে পারছি না!
আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে তিনি নিজেই বলা শুরু করলেন-
- "আমি ওনার ছেলের বৌ, সাবিনা। আপনে চইলা যাওয়ার দুই মাসের মধ্যেই আমারে এই বাড়িতে ওনার পোলার লাইগা বৌ কইরা নিয়া আসছিল। "
- "ও"।
- "আপনেরা একটু বসেন, আমি আইতাছি "
কথাটা বলেই ভদ্রমহিলা অন্য ঘরে চলে গেলেন। আমি উনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।
মানুষের জীবন কতো অদ্ভুত!
আজ আমরা দুই অভাগী নারী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে , অথচ আমাদের সম্পর্কের কোন নাম নেই !
অপরিচিত মানুষের মাঝেও একটা সম্পর্ক থাকে। "অপরিচিত" শব্দটিও একটা সম্পর্কের নাম কিন্তু এই নারীর সাথে আমার সম্পর্কের কোন নাম নেই, সে আমার প্রাক্তন স্বামীর বর্তমান স্ত্রী, আর আমি এই নারীর বর্তমান স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রী !
এই পৃথিবীতে মানুষের জীবনে কতো সম্পর্ক আসা যাওয়া করে তার ভেতরেও এমন কিছু সম্পর্ক থেকে যায় যার মাঝে একবোধহীন বোধ কাজ করে!
কি নাম দেয়া যেতে পারে! সে তো এখন আমার সতীন না। তবে ? কি সে?
- "আপা শরবতটা খাইয়া লন, বাইরে ঠাডা পড়া রোইদ পড়ছে , অনেক দূর থেইকা আইছেন। লন।"
আমি "আপা" সম্বোধনে চমকে উঠলাম। শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে পাশে থাকা টেবিলের এক কোণে রেখে দিয়ে বললাম
-
- আপনি আমাকে আসার জন্য জরুরী বার্তা পাঠিয়েছেন ?
- জি আপা। আম্মা কয়দিন ধইরা খালি আপনের কথাই কইছে।
(আমি তার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম।)
যেই দিন জবান বন্ধ হইয়া গেল ,সেই দিনেও আপনের নাম নিয়া কইছিল, আছিয়ারে খবর দাও, ওর কাছে আমি মাফ চামু, আছিয়া যদি আমারে মাফ না করে আল্লাহও আমারে মাফ করবো নারে । গেল কয় দিন আছিয়া আছিয়া ছাড়া আর কারও নাম নেয় নাই আফা। বলেই ভদ্রমহিলা আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছলেন। আমার শাশুড়ির মতো মানুষই হয় না। ফেরেস্তার লাহান মানুষটা দিন দিন কেমন হইয়া গেল!
কথাটা বলেই আবারো আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন।
আমার কন্ঠনালীতে একটা দীর্ঘশ্বাস দলা পেকে আটকে গেল।
এ আমি কি শুনছি!
যে নারী এক সময় আমার ছায়াকেও অপবিত্র মনে করতেন, সেই নারীই কিনা মৃত্যু শয্যায় আমার দেখা পেতে ব্যকুল হয়ে আছেন!
যে নারী কিনা আমাকে বাজা, বন্ধ্যা, অলক্ষ্মী, ছাড়া কোন দিন আমার নাম উচ্চারণ করে ডাকেননি, সেই নারীই কিনা আজ আজরাইল আসার সময় হয়েছে বলে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে অধির হয়ে আছেন!
যে নারী বিনাদোষে আমার গায়ে হাত তুলেছেন সেই নারীই কিনা ফেরেস্তার মতো ভালো!
দুঃখে হাসি পাচ্ছে,আজ তিনি আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন কিন্তু এখন ক্ষমা চেয়ে কি লাভ!
তিনিই তো তার সাথে আমার সমস্ত সম্পর্কের ইতি টেনে দিয়েছিলেন সেই দিনই , যেই দিন তার ছেলেকে বিষের বোতল দেখিয়ে বলেছিলেন, " তুই যদি আছিয়ারে এহনি তিন তালাক না দেস তো আমি এই বিষের বোতল তোর সামনেই খামু।"
তার ছেলে তখন কথাটা আমলে নেয় নাই। ভাবতাম মানুষটা আমাকে বড় ভালোবাসে, সে কখনোই আমারে ছাড়তে রাজি না। কিন্তু বিয়ের চার বছর পার হলেও যখন আমি তার সন্তানের মা হতে পারিনি, তখন ঠিকই মায়ের কথা বিশ্বাস করে আমাকে কথায় কথায় নির্যাতন করা শুরু করেছিলেন।
আমার পাপ, এ বংশের জন্য আলো আমার গর্ভে আসেনি!
আমার চলনে,বলনে,কাজে,কর্মে সমস্ত জায়গাতেই আমার শাশুড়ি অপবিত্রতা দেখতে পান।
আমার পায়ের গোড়ালি এমন কেন!শুরু করতেন কটাক্ষ করা!
মা-বাবার নাম ধরে গালি-গালাজ করতেও কখনোই দ্বিধা করেননি।
আমার মাথা থেকে কাপড় খসে পড়লো কেন এই দোষে কতোবার যে চুলের মুঠি ধরে গঞ্জনা করেছেন তার হিসাব রাখা মুশকিল।
স্মৃতির ক্যানভাসে বহেমিয়ান হয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সব দিনগুলোর কথা!
- আপা, আসলে আমাগো শাশুড়ি খারাপ মানুষ না! আপনে তো জানেন না, তিনি এক ভন্ড পীরের মুরিদ আছিল!
হেই পীরেই কইছিল আপনের লগে বদজীনের আছর আছে। আপনেরে তালাক না দিলে এই বাড়ির প্রদীপ চিরদিনের জন্য নিভ্যা যাইবো। আপা, আমি হেই পীরেরই মাইয়া। আমার বাপে মইরা যাওয়ার আগে সব কইয়া গেছে আপা। আপনে আমার বাপেরে মাফ কইরা দিয়েন।
কথা গুলো বলেই আমার পা দুটো জাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো সাবিনা।
এ কান্না একজন পিতার জন্য তার সন্তানের। এ কান্নাকে অবহেলা করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি সাবিনাকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
- আর কেঁদো না বোন। ওঠো। আমি সবাইকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। যদি ক্ষমা না করতে পারতাম তবে তো এ বাড়িতে পা রাখতাম না বোন!
আমি আমার প্রাক্তন শাশুড়ির হাতে হাত রেখে বললাম, -দোয়া করবেন। আপনার উপরে আমার কোন রাগ নেই! যা ঘটেছে তা আমার নিয়তিতেই লেখা ছিল। নিয়তি খন্ডনের ক্ষমতা কারো নেই! আমার দুই ছেলে দেখিয়ে বললাম- আমি বন্ধ্যা নই!
কথাটা বলেই আমি ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালাম। বুকের মাঝে ঘুমন্ত মহাসাগরের স্রোত যেন পাঁজর ভেঙে চুরমার করে দিতে চাইছে। মানুষের মন কতো অদ্ভুত !
হাসির কথা বারবার মনে পড়লে যে মানুষ আগের মতো হাসে না সেই মানুষটা এতো অতীতের দুঃখের কথা মনে করে কাঁদে কেন?
আমি আমার দুই ছেলেকে ডেকে বাড়ির উঠোন পেরিয়ে পুকুরের পাশ দিয়ে দ্রুত রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি! আমার বর্তমান স্বামী আমার জন্য বড় রাস্তায় অপেক্ষা করছেন।
- আপা! আপা!
আমি সাবিনার ডাকে থমকে দাঁড়ালাম। সাবিনা হাঁপাচ্ছে আর বলছে-
- আপা গো! এই শিউলি গাছের তলে উনার কবর! গতোবছর রোড একসিডেন্টে তিনি চইলা গেছেন।একবার চাইয়া দেখেন! উনার কবরের উপ্রে আপনের লাগাইন্যা শিউলি গাছটা তার ফুলে ফুলে কেমন বিছানার লাহান ভরাইয়া রাখছে! দেখেন আপা!
আমি কোন দিকে না ফিরেই বললাম -
- তার কবরটা দেখাও এখন আমার জন্য নিষেধ সাবিনা!
আমি দ্রুত পুকুর পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে এলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি আমার স্বামী শামস দাঁড়িয়ে। দৌড়ে তাকে জাপটে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম, তিনি আমার কান্না থামানোর কোন চেষ্টা না করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
- বউ , দেখো তোমার গা থেকে শিউলি ফুলের খুব মিষ্টি একটা সুবাস আসছে!