দূরবিষময় জীবন

নিজের সমস্যা

মেয়েটি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে, ব্যাপক পরিচিত এবং শক্তিশালী একটি সংগঠন তার। মেয়েদের অধিকারের পক্ষে এবং হ্যারাজমেন্টের বিরুদ্ধে অনেক কার্যকরভাবে কাজ করে।

 

...অথচ নিজে এমন একটি সমস্যায় জড়িয়ে গিয়েছে যেখানে তার সংগঠন, ক্ষমতা বা আইন কোন কাজে আসছে না। আইনীভাবে সমাধান করার মত সমস্যাও না, একান্তই মানসিক।

 

মহিলাটি নিজেই আইনজীবি। বিশেষ করে মহিলাদের আইনী সহায়তা দেয়ার জন্য নিবেদিত সে। প্রতিদিন যে কত মহিলাকে আইনী সহায়তা ও পরামর্শ দেয় হিসেব নেই। পারিবারিক সমস্যা, দাম্পত্য কলহ, স্বামীর অত্যাচার, ডিভোর্স সব নিয়ে পরামর্শ দেয়।

 

এদিকে তার নিজের ঘরে স্বামীর সাথে ভাল সম্পর্ক নেই। খাবার-দাবার, টাকা-পয়সা কোন কিছুর অভাব নেই তার; কিন্তু দুজনের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক, স্বামীর মমতা তা নেই। এক্ষেত্রে আইন খাটে না। তার আইন এখানে অক্ষম জোর করে "স্বামীর মমতা" আদায় করতে।

 

ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক করা নিয়ে ঘটা কত সংসারের সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন কাজ করে সে। অথচ তার স্বামী প্রতিরাতে মেয়েদের সাথে সময় কাটিয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে, এক্ষেত্রে কিছুই করতে পারছে না সে। করবেই বা কিভাবে, স্বামী নিজেও তো কম ক্ষমতাধর না।

 

লোকটি সাইকোলজিস্ট, প্রতিদিন তার চেম্বারে আসা কত মানুষের কাউন্সিলিং করেন। মানুষকে সমস্যার মাঝে আশার আলো দেখান, বাঁচতে শেখান।

 

অথচ দিনশেষে ঘরে ফিরে সে যে একা, বড্ড একা সেই খবর সবার অজানা। তার জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুঁজতে সে নিজেই ক্লান্ত। জীবন নামক অংকের যেই জটিলতায় সে আটকে আছে তার হিসেব মিলাতে কেটে যাচ্ছে তার দিনরাত।

 

কোন পেশেন্টের ক্ষেত্রে এরচেয়ে জটিল সমস্যা হলেও সমাধান করে দিত। কিন্তু তার সমাধান কে দিবে? স্বান্তনা বাণী আর অনুপ্রেরণার গল্প বলে অন্যকে তো বুঝানো যায়; কিন্তু নিজের বানানো গল্পে নিজেকে স্বান্তনা কিভাবে দিবে? তাই বেলাশেষে তার মনেও ভর কর খানিক বিষাদ, হতাশা আর চিন্তা।

 

লোকটি অঢেল সম্পত্তির মালিক। বেহিসেবে দান করে। অর্থ-বিত্তের কোন অভাব নেই; কিন্তু মনে শান্তির যেই অভাব, পরিবারের যেই জটিলতা, সন্তানের অধঃপতন নিয়ে যে হতাশা তার সমাধান কোটি টাকায়ও মিলবে না।

 

মহিলাটি বাচ্চাদের ডাক্তার, প্রতিদিন কতজনের বাচ্চার চিকিৎসা করে, চেম্বারে কত সুন্দর সুন্দর বাচ্চারা বাবা-মায়ের সাথে আসে।

 

অথচ দিনশেষে ঘরে ফিরে যখন উপলব্ধি করে এতশত বাচ্চার মধ্যে একটাও তার না, তার নিজের ঘরে কোন বাচ্চা নেই তখন বিষাদ তার মনেও ভর করে। কারন তার ঘরে আর সন্তান আসবে না, এর সমাধান তার ডাক্তারি বিদ্যার উর্ধ্বে।

 

...আসলে প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে একটা লুকানো দুঃখ ও বিষাদের জায়গা থাকে যার কোন সমাধান কখনো হয় না আর কাউকে সমাধান চাইতে ডাকাও যায়না।

 

যারা অন্যকে সাপোর্ট দিতে অনেক কাজ করে তার নিজের একান্ত বিরহে, বড় সমস্যায়ও তার প্রকাশ করা যায় না। কারন তার নিজের হাসি দেখে শত শত মানুষ আশার আলো পাবে, বাঁচতে শিখবে; সেখানে তার কাঁদলে হবে না।

 

কান্নায় বুক ফেটে আসলেও ঢেকুরের সাথে সযত্নে কান্নাটা গিলে মুখে হাসি ফুটিয়ে সবার পাশে দাড়াতে হবে। তার এই হাসিমাখা মুখের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে সবাই হাসবে, আর সেই হাসির মাঝে সে নিজের সুখ খুঁজে নিবে।

 

...যারা অনেক মানুষ নিয়ে কাজ করে, মানুষের জন্য কাজ করে; দিনশেষে তারাই সবচেয়ে বেশি একা। হাজার মানুষ থাকলেও তাদের নিজের একান্ত কথা বলা, সময় কাটানো বা অনুভূতি শেয়ার করার কেউ থাকে না। অথবা থাকলেও বলা যায় না।

 

তাদের জীবনটা হয়ে যায় যান্ত্রিক। গৎবাধা নিয়মে রোবটের মত চলতে হয়। আবেগ, অনুভূতি এসবের দিকে তাকানোর সময় থাকে না, সময় থাকলেও তাকানো যায় না। কারন সে নিজের দিকে তাকালে অন্যের সমাধান করবে কে?

 

তাদেরকে মুখোশধারী হতে হয়। এই মুখোশের আড়ালে নিজের সব সমস্যা, দুঃখ, কষ্ট, অভিমান, হতাশা সব লুকিয়ে রেখে অন্যকে স্বান্তনা দিতে হয়।

 

গুরুদায়িত্ব যে তার কাধে। সেই দায়িত্ব আর কর্তব্যের টানে দিনশেষে জমা হাজারো বিষাদ ভোরের আলো ফোটার আগেই লুকিয়ে রেখে নতুন সকালে নতুন সম্ভাবনায় মানুষকে জাগানোর জন্য পথ চলতে হয়।

 

জোকার দিনশেষে ঘরে ফিরে সারারাত কাঁদলেও কাউকে তা দেখতে দেয়া যায়না। দিনের আলোতে ঠিকই চোখের পাশে রঙ মেখে কান্নার দাগ লুকাতে হয়। অন্যদের হাসানোর জন্য রঙিন পোষাক গায়ে চাপাতে হয়; সেই পোষাকে তাকে দেখে সবাই হাসবে আর সেই পোষাকের আড়ালেই তাকে লুকাতে হবে নিজের দুঃখ, কষ্ট, অভিমান, কান্না আর না বলা সব কথা।


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments