দেনা-পাওনা ষোলতম খন্ড

Comments · 2 Views

চৈত্রের সংক্রান্তি নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল—’শিব-শম্ভু’র গাজন-উৎসবে কোথাও কিছুমাত্র বিঘ্ন ঘটিল না।

কোথাও একটা ডাকাতি হতে যা দেরি। জানো ত মা, বছর-দুই করে একবার খেটে

এসেচি, এবার দশ বছরের মত একেবারে নিশ্চিন্ত।

খুড়োর গঙ্গালাভ তার মধ্যেই হবে, তবে আমার বয়সটা এখনও কম, হয়ত আর-একবার দেশের মুখ দেখতেও পাবো। বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।

 

ষোড়শী ভয় পাইয়া কহিল, হাঁ রে, এ কি তোরা সত্যি বলে মনে করিস?

 

সাগর বলিল, মনে করি? এ ত চোখের উপর স্পষ্ট দেখতে পাচ্চি মা।

জেলের বাইরে আমাদের রাখতে পারে এ সাধ্যি আর কারও নেই। বেশী নয়, দু’মাস এক মাস দেরি, হয়ত নিজের চোখেই দেখে যেতে পারবে মা।

 

ষোড়শী কহিল, আর যারা ওখানে গেছে, তাদের?

 

সাগর বলিল, তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও মন্দ।

জেলের মধ্যে খেতে দেয়, যা হোক আমরা দুটো খেতে পাবো, কিন্তু এরা তাও পাবে না। নালিশগুলো সব ডিক্রি হতে যা বিলম্ব,

 তার পরে রায়মশায়ের নিজ জোতে জন খেটে দু’মুঠো জোটে ভাল, না হয় আসামের চা-বাগান ত আছে।

কেমন মা, তোমারই কি মনে পড়ে না ওই বেনের-ডাঙাটায় আগে আমাদের কত ঘর ভূমিজ বাউরির বসতি ছিল,

কিন্তু আজ তারা কোথায়? কতক গেল কয়লা খুঁড়তে, কতক গেল চালান হয়ে চা-বাগানে। কিন্তু আমি দেখেচি ছেলেবেলায় তাদের জমিজমা হাল-বলদ।

দু-মুঠো ধানের সংস্থান তাদের সব্বায়ের ছিল। আজ তাদের অর্ধেক এককড়ি নন্দীর, অর্ধেক রায়মশায়ের।

 

ষোড়শী স্তদ্ধভাবে দাঁড়াইয়া সমস্ত ব্যাপারের গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে লাগিল।

 এই সেদিন যাহারা দল বাঁধিয়া তাহার আশ্রয় চাহিতে আসিয়াছিল, আজ অক্ষম জানিয়া প্রবলের চোখের ইঙ্গিতে তাহারই বিরুদ্ধে তাহারা মন্ত্রণা করিতে একত্র হইয়াছে—

সেদিনের সমস্ত কল্পনা তাহাদের কোথায় ভাসিয়া গেল। যে প্রবল, যে ধনবান, যে ধর্মজ্ঞানবিরহিত, তাহার অত্যাচার হইতে বাঁচিবার কোন পথ দুর্বলের নাই। কোথাও ইহার নালিশ চলে না,

ইহার বিচার করিবার কেহ নাই—ভগবান কান দেন না, সংসারে চিরদিন ইহা অবারিত চলিয়া আসিতেছে। এই যে আজ এতগুলি লোক গিয়া একটিমাত্র

 প্রবলের পদতলে তাহাদের বিবেক, ধর্ম, মনুষ্যত্ব সমস্ত উজাড় করিয়া দিয়া কোনমতে বাঁচিয়া থাকিবার একটুখানি আশ্বাস লইয়া ঘরে ফিরিয়া আসিল,

ইহার লজ্জা, ইহার দৈন্য, ইহার ব্যথা যত বড়ই হোক, যতদূর দেখা যায়, এই দুঃখীদের এই ক্ষুদ্র কৌশলটুকু ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই চোখে পড়ে না। যে অন্যায় এতগুলি মানুষকে এমন অমানুষ করিয়া দিল, তাহাকে প্রতিহত করিবার শক্তি এতবড় বিশ্ব-বিধানে কৈ?

এই যে সাগর সর্দার সেদিন পীড়িতের পক্ষ গ্রহণ করিয়াছিল, দুর্বলের এতবড় স্পর্ধার সহস্র গুণ বড় দণ্ড তাহার তোলা আছে—অব্যাহতির কোন পথ নাই। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা সাগর, এ-সব তুই শুনলি কার মুখে?

 

সাগর কহিল, স্বয়ং হুজুরের মুখে।

 

তাহলে এ-সকল তাঁরই মতলব?

 

সাগর চিন্তা করিয়া কহিল, কি জানি মা, কিন্তু মনে হয় রায়মশায়ও আছেন।

 

ষোড়শী একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, আচ্ছা সাগর, তুই বলতে পারিস, জমিদার আমার উপর অত্যাচার করেন না কেন? আমি ত ভাঙা কুঁড়েয় একলা থাকি, ইচ্ছে করলেই ত পারেন?

 

সাগর হাসিল, কহিল, কে তোমাকে বললে মা তুমি একলা থাকো? মা, আমাদের নিজের পরিচয় নিজে দিতে নেই,—গুরুর নিষেধ আছে,

বলিতে বলিতে সহসা তাহার বলিষ্ঠ দক্ষিণ হাতের পাঁচটা আঙ্গুল লাঠির গায়ে যেন ইস্পাতের সাঁড়াশির মত চাপিয়া বসিল, কহিল, যার ভয়ে চণ্ডীর মন্দিরে না বসে ষোল আনা বসতে গেল আজ এককড়ির কাছারি-বাড়িতে,

 তারই ভয়ে কেউ তোমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। হরিহর সর্দারের ভাইপো সাগরের নাম দশ-বিশ ক্রোশের লোকে জানে, তোমার উপর অত্যাচার করবার মানুষ ত মা পঞ্চাশখানা গ্রামে কেউ খুঁজে পাবে না।

ষোড়শীর দুই চক্ষু অকস্মাৎ জ্বলিয়া উঠিল; কহিল, সাগর, এ কি সত্য?

 

সাগর হেঁট হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহার হাতের লাঠিটা ষোড়শীর পায়ের নীচে রাখিয়া দিয়া কহিল, বেশ ত মা, সেই আশীর্বাদ কর না যেন কথা আমার মিথ্যে না হয়।

 

ষোড়শীর চোখের দৃষ্টি একবার একটুখানি কোমল হইয়াই আবার তেমনি জ্বলিতে লাগিল, কহিল, আচ্ছা সাগর, আমি ত শুনেচি তোদের প্রাণের ভয় করতে নেই?

 

সাগর সহাস্যে কহিল, মিথ্যে শুনেচ তাও ত আমি বলচি নে মা।

 

ষোড়শী কহিল, কেবল প্রাণ দিতেই পারিস, আর নিতে পারিস নে?

 

সাগর কহিল, একটা হুকুম দিয়ে আজ রাত্রেই কেন যাচাই কর না মা?

এই বলিয়া সে ষোড়শীর মুখের উপর দুই চোখ মেলিয়া ধরিতে ষোড়শী বিস্ময়ে ও ভয়ে একেবারে নির্বাক হইয়া গেল। সাগরের চাহনি এক পলকে বদলাইয়া গেছে। 

সেই স্বাভাবিক দীপ্তি নাই, সে তেজ নাই, সে কোমলতা কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে—নিষ্প্রভ, সঙ্কুচিত গভীর দৃষ্টি—এ যেন আর সে সাগর নয়, এ যেন আর কেহ।

সাগর কথা কহিল। কণ্ঠস্বর শান্ত কঠিন, অত্যন্ত ভারী। কহিল, রাত বেশী হয়নি—ঢের সময় আছে। মা চণ্ডীর কপাট তাই এখনো খোলা আছে মা, আমি তোমার হুকুম শুনতে পেয়েচি।

বেশ, তাই হবে মা, পাপের শেষ করে দেব—সকালেই শুনতে পাবে, তোমার সাগর সর্দার মিছে অহঙ্কার করে যায়নি। তাহার পিতৃ-পিতামহের হাতের সুদীর্ঘ লাঠিখানা ত ষোড়শীর পায়ের কাছে পড়িয়া ছিল,

 হেঁট হইয়া তৎক্ষণাৎ তুলিয়া লইয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল।ষোড়শী কথা কহিতে গেল, তাহার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল,

নিষেধ করিতে চাহিল, কণ্ঠে স্বর ফুটিল না, ভূমিকম্পের সমুদ্রের মত অকস্মাৎ সমস্ত বুক জুড়িয়া দোলা উঠিল, এবং নিমেষের জন্য সাগরের এই একান্ত অপরিচিত ঘাতকের মূর্তি তাহার চোখের উপর হইতে অদৃশ্য হইয়া গেল।

সাগর কি যেন একটা কহিল, কিন্তু সে বুঝিতে পারিল না, কেবল এইটুকুমাত্র উপলব্ধি করিল যে, সে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া দ্রুতবেগে বাহির হইয়া যাইতেছে।

Comments
Read more