তখন হঠাৎ একদিন সে চন্দ্রমুখীকে চিঠি লিখিয়াছিল, বৌ, মনে করেছিলাম,
আর কখনো ভালবাসব না। একে ত ভালবেসে শুধুহাতে ফিরে আসাটাই বড় যাতনা,
তার পরে আবার নূতন করে ভালবাসতে যাওয়ার মত বিড়’না সংসারে আর নেই।
প্রত্যুত্তরে চন্দ্রমুখী কি লিখিয়াছিল তাহাতে আবশ্যক নাই;
কিন্তু এই সময়টায় দেবদাসের কেবলই মনে হইত, সে একবার এলে হয় না!
পরক্ষণে সভয়ে ভাবিত-না, না, কাজ নেই,-কোনদিন পার্বতী যদি জানতে পারে!
এমনি করিয়া একবার পার্বতী, একবার চন্দ্রমুখী তাহার হৃদয়রাজ্যে বাস করিতেছিল।
কখনও বা দু’জনের মুখই পাশাপাশি তাহার হৃদয়পটে ভাসিয়া উঠিত-যেন উভয়ের কত ভাব!
মনের মাঝে দু’জনেই পাশাপাশি বিরাজ করিত। কোনদিন বা অত্যন্ত অকস্মাৎ মনে হইত,
তাহারা দু’জনেই যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। এই সময়টায় মনটা তাহার এমনি অন্তঃসারশূন্য হইয়া পড়িত যে,
শুধু একটা নির্জীব অতৃপ্তিই তাহার মনের মধ্যে মিথ্যা প্রতিধ্বনির মত ঘুরিয়া বেড়াইত।
তার পরে দেবদাস লাহোরে চলিয়া গেল। এখানে চুনিলাল কাজ করিতেছিল, সন্ধান পাইয়া দেখা করিতে আসিল।
বহুদিন পরে দেবদাস সুরা স্পর্শ করিল। চন্দ্রমুখীকে মনে পড়ে, সে নিষেধ করিয়া দিয়াছিল। মনে হয়, তার কত বুদ্ধি।
সে কত শান্ত, ধীর; আর তার কত স্নেহ। পার্বতী এখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল-শুধু নির্বাণোন্মুখ দীপশিখার মত কখনো কখনো জ্বলিয়া জ্বলিয়া উঠিত।
কিন্তু এখানকার জলবায়ু তাহার সহিল না। মাঝে মাঝে অসুখ হয়, পেটের কাছে আবার যেন ব্যথা বোধ হয়।
ধর্মদাস একদিন কাঁদ-কাঁদ হইয়া কহিল, দেব্তা, তোমার শরীর আবার খারাপ হচ্চে-আর কোথাও চল।
দেবদাস অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল, চল যাই।দেবদাস প্রায় বাসাতে মদ খায় না। চুনিলাল আসিলে কোনদিন খায়, কোন দিন বাহির হইয়া চলিয়া যায়।
রাত্রিশেষে বাটী ফিরিয়া আসে, কোন রাত্রি বা একেবারেই আসে না। আজ দুইদিন হইতে হঠাৎ তাহার দেখা নাই। কাঁদিয়া ধর্মদাস অন্নজল স্পর্শ করিল না।
তৃতীয় দিনে দেবদাস জ্বর লইয়া বাটী ফিরিয়া আসিল; শয্যা লইল, আর উঠিতে পারিল না। তিন-চারিজন ডাক্তার আসিয়া চিকিৎসা করিতে লাগিল।
ধর্মদাস কহিল, দেব্তা, কাশীতে মাকে খবর দিই-
দেবদাস তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া কহিয়া উঠিল, ছিঃ ছিঃ-মাকে কি এ মুখ দেখাতে পারি?
ধর্মদাস প্রতিবাদ করিল, রোগ-শোক সকলেরই আছে; কিন্তু তাই বলে কি এতবড় বিপদের দিনে মাকে লুকানো যায়?
তোমার কোন লজ্জা নাই, দেব্তা, কাশীতে চল।
দেবদাস মুখ ফিরাইয়া কহিল, না, ধর্মদাস, এ সময়ে তাঁর কাছে যেতে পারব না। ভাল হই, তার পরে।
ধর্মদাস একবার মনে করিল, চন্দ্রমুখীর উল্লেখ করে; কিন্তু নিজে তাহাকে এত ঘৃণা করিত যে, তাহার মুখ মনে পড়িবামাত্রই চুপ করিয়া রহিল।
দেবদাসের নিজেরও অনেকবার এ কথা মনে হইত; কিন্তু কোন কথা বলিতে ইচ্ছা করিত না।
সুতরাং কেহই আসিল না। তার পর অনেক দিনে সে ধীরে ধীরে আরোগ্য হইতে লাগিল।
একদিন সে উঠিয়া বসিয়া বলিল, চল ধর্মদাস, এইবার আর কোথাও যাই।
আর কোথাও গিয়ে কাজ নেই ভাই, হয় বাড়ি চল, না হয় মায়ের কাছে চল।
জিনিসপত্র বাঁধিয়া চুনিলালের নিকট বিদায় লইয়া, দেবদাস আবার এলাহাবাদে আসিয়া উপস্থিত হইল-শরীরটা অনেকটা ভাল।
কিছুদিন থাকিবার পর একদিন দেবদাস কহিল, ধর্ম কোন নূতন জায়গায় গেলে হয় না? কখনো বো’ম্বাই দেখিনি , যাবে?
আগ্রহ দেখিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধর্মদাস মত দিল। সময়টা জ্যৈষ্ঠ মাস; বো’ম্বাই শহর তেমন গরম নয়। এখানে আসিয়া দেবদাস অনেকটা সারিয়া উঠিল।
ধর্মদাস জিজ্ঞাসা করিল, এখন বাড়ি গেলে হয় না?
দেবদাস কহিল, না, বেশ আছি। আমি এখানেই আর কিছুদিন থাকব।
এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। ভাদ্র মাসের সকালবেলায়,
একদিন দেবদাস ধর্মদাসের কাঁধে ভর দিয়া বো’ম্বাই হাসপাতাল হইতে বাহির হইয়া গাড়িতে আসিয়া বসিল।
ধর্মদাস কহিল, দেব্তা, আমি বলি, মায়ের কাছে যাওয়া ভাল।
দেবদাসের দু’চক্ষু জলে ভরিয়া গেল-আজ কয়দিন হইতে মাকে তাহার কেবল মনে পড়িতেছিল।
হাসপাতালে পড়িয়া যখন তখন এই কথাই ভাবিয়াছে,-এ সংসারে তাহার সবই আছে, অথচ কেহই নাই।
তাহার মা আছেন, বড় ভাই আছেন, ভগিনীর অধিক পার্বতী আছে-চন্দ্রমুখীও আছে! তাহার সবাই আছে, কিন্তু সে আর কাহারও নাই।
ধর্মদাসও কাঁদিতেছিল; কহিল, তাহলে দাদা, মায়ের কাছে যাওয়াই স্থির?
দেবদাস মুখ ফিরাইয়া অশ্রু মুছিল; বলিল, না ধর্মদাস, মাকে এ মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না,-আমার এখনো বোধ করি সে সময় আসেনি।
বৃদ্ধ ধর্মদাস হাউহাউ করিয়া কাঁদিয়া কহিল, দাদা, এখনো যে মা বেঁচে আছেন!
কথাটায় কতখানি যে প্রকাশ করিল, তাহা অন্তরে উভয়েই অনুভব করিল।
দেবদাসের অবস্থা অত্যন্ত মন্দ হইয়াছে। সমস্ত পেট প্লীহা-লিভারে পরিপূর্ণ; তাহার উপর জ্বর, কাশি। রঙ গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ, দেহ অস্থিচর্মসার।
চোখ একেবারে ঢুকিয়া গিয়াছে, শুধু একটা অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় চকচক করিতেছে। মাথায় চুল রুক্ষ ও ঋজু-চেষ্টা করিলে বোধ হয় গুণিতে পারা যায়। হাতের আঙ্গুলগুলার পানে চাহিলে ঘৃণা বোধ হয়-একে শীর্ণ,
তাহাতে আবার কুৎসিত ব্যাধির দাগে দুষ্ট। স্টেশনে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথাকার টিকিট কিনব দেবদা?
তালসোনাপুর নাম শুনিয়া মহেন্দ্র কহিল, ছোটমার বাপের বাড়ির লোক, তিনি দেখলে-
চৌধুরীমহাশয় তাড়া দিলেন, সে কি এখানে মড়া সনাক্ত করতে আসবে নাকি?
দারোগাবাবু সহাস্যে কহিলেন, পাগল আর কি!
ব্রাহ্মণের মৃতদেহ হইলেও পাড়াগাঁয়ে কেহ স্পর্শ করিতে চাহিল না; কাজেই চণ্ডাল আসিয়া বাঁধিয়া লইয়া গেল।
তার পর কোন শুষ্ক পুষ্করিণীর তটে অর্ধদগ্ধ করিয়া ফেলিয়া দিল-কাক-শকুন উপরে আসিয়া বসিল, শৃগাল-কুক্কুর শবদেহ লইয়া কলহ করিতে প্রবৃত্ত হইল।
তবুও যে শুনিল, সেই কহিল, আহা! দাসী চাকরও বলাবলি করিতে লাগিল, আহা ভদ্দরলোক, বড়লোক!
দু শ’ টাকা দামের শাল, দেড় শ’ টাকা দামের আংটি! সে-সব এখন দারোগার জিম্মায় আছে; পত্র দু’খানাও তিনি রখিয়াছেন।খবরটা সকালেই পার্বতীর কানে গিয়াছিল বটে,
কিন্তু কোন বিষয়েই আজকাল সে মনোনিবেশ করিতে পারিত না বলিয়া ব্যাপারটা ঠিক বুঝিতে পারে নাই। কিন্তু সকলের মুখেই যখন ঐ কথা,
তখন পার্বতীও বিশেষ করিয়া শুনিতে পাইয়া সন্ধ্যার পূর্বে একজন দাসীকে ডাকিয়া কহিল, কি হয়েচে লা? কে মরেচে?
দাসী কহিল, আহা, কেউ তা জানে না মা! পূর্বজন্মের মাটি কেনা ছিল, তাই মরতে এসেছিল। শীতে হিমে সেই রাত্রি থেকে পড়ে ছিল, আর বেলা ন’টার সময় মরেচে।
পার্বতী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আহা, কে তা কিছু জানা গেল না।
দাসী বলিল, মহেনবাবু সব জানেন, আমি অত জানিনে মা।
মহেন্দ্রকে ডাকিয়া আনা হইলে সে কহিল, তোমাদের দেশের দেবদাস মুখুয্যে।
পার্বতী মহেন্দ্রর অত্যন্ত নিকটে সরিয়া আসিয়া, তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে, দেবদাদা? কেমন করে জানলে?
পকেটে দু’খানা চিঠি ছিল; একখানা দ্বিজদাস মুখুয্যে লিখচেন-
পার্বতী বাধা দিয়া কহিল, হাঁ, তার বড়দাদা।
আর একখানা কাশীর হরিমতী দেবী লিখেচেন-
হাঁ, তিনি মা।
হাতের উপর উলকি দিয়ে নাম লেখা ছিল-
পার্বতী কহিল, হাঁ, কলকাতায় প্রথম গিয়ে লিখিয়েছিলেন বটে-
একটা নীল রংয়ের আংটি-
পৈতার সময় জেঠামশাই দিয়েছিলেন। আমি যাই,-বলিতে বলিতে পার্বতী ছুটিয়া নামিয়া পড়িল।
মহেন্দ্র হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, ও মা, কোথা যাও?
দেবদার কাছে।
সে ত আর নেই-ডোমে নিয়ে গেছে।
ওগো, মা গো। বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে পার্বতী ছুটিল। মহেন্দ্র ছুটিয়া সম্মুখে আসিয়া বাধা দিয়া বলিল, তুমি কি পাগল হলে মা? কোথা যাবে?
পার্বতী মহেন্দ্রের পানে তীব্র কটাক্ষ করিয়া কহিল, মহেন, আমাকে কি সত্যি পাগল পেলে? পথ ছাড়।
তাহার চক্ষের পানে চাহিয়া, মহেন্দ্র পথ ছাড়িয়া নিঃশব্দে পিছনে পিছনে চলিল। পার্বতী বাহির হইয়া গেল। বাহিরে তখনও নায়েব গোমস্তা কাজ করিতেছিল, তাহারা চাহিয়া দেখিল। চৌধুরীমহাশয় চশমার উপর দিয়া চাহিয়া কহিলেন, যায় কে?
মহেন্দ্র বলিল, ছোটমা।
সে কি? কোথায় যায়?
মহেন্দ্র বলিল, দেবদাসকে দেখতে।
ভুবন চৌধুরী চীৎকার করিয়া উঠিলেন, তোরা কি সব ক্ষেপে গেলি, ধর-ধর-ধরে আনো ওকে। পাগল হয়েচে! ও মহেন, ও কনেবৌ!
তাহার পর দাসী-চাকর মিলিয়া ধরাধরি করিয়া পার্বতীর মূর্ছিত দেহ টানিয়া আনিয়া বাটীর ভিতরে লইয়া গেল। পরদিন তাহার মূর্ছাভঙ্গ হইল, কিন্তু সে কোন কথা কহিল না। একজন দাসীকে ডাকিয়া শুধু জিজ্ঞাসা করিল, রাত্রিতে এসেছিলেন, না? সমস্ত রাত্রি!
তাহার পর পার্বতী চুপ করিয়া রহিল।
এখন এতদিনে পার্বতীর কি হইয়াছে, কেমন আছে জানি না।
সংবাদ লইতেও ইচ্ছা করে না। শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়। তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মত দুঃখ পাইবে।
তবু যদি কখনও দেবদাসের মত এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও। প্রার্থনা করিও,
আর যাহাই হোক, যেন তাহার মত এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই,
কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে-যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।