২ প্রকার আয়নাঘর

আয়না ঘরের বিচিত্র

শিবিরের আয়নাঘর!

 

আপনারা কি জানেন শিবিরের আয়নাঘর আছে?

তবে এই আয়নাঘর আর হাসিনার আয়নাঘরের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।

 শিবিরের আয়নাঘরে তারা ইচ্ছা করেই যায়। শোনেন সেই আয়নাঘরের বর্ণনা।

 

২০০৯/১০ সালে আশুলিয়ায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরির সুবাদে রাসেল নামে জামগড়ার একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল।

 

আমার বাসা তখন ছিল শ্যামলীতে। আবার রাতে দেরি হলে আশুলিয়ায় থাকার জন্য সেখানে কলিগরা মিলে একটা রুম ভাড়া করেছিলাম।

রাসেল ছেলেটা পাশে রুমে ৩ জন মিলে থাকত। ছেলেটা আমার শ্যামলীর বাসার কথা জানত।

 আমাকে একদিন বলল "আমি কয়েক মাস আপনাদের শ্যামলীতে থেকে কোচিং করব।"

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম "কোচিং তো সাভারেই আছে। এছাড়া আশুলিয়া থেকে শ্যামলীতে তো দিনে গিয়ে ক্লাস করে আবার দিনে ফেরা যায়।

 কেন সেখানে শুধু শুধু টাকা খরচ করে থাকতে হবে?" টাকার কথা বললাম এ কারণে যে ছেলেটার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না।

 একটা বাড়িতে লজিং থাকে আর ১ টা টিউশনি করে লেখাপড়া করছে, ছাত্র হিসেবে খুবই মেধাবী ছিল।

ছেলেটা উত্তর দিল "দেখা যাক কী হয়? আমার মনে হয় টাকা লাগবে না। ফ্রী ক্লাস করা যায় কিনা দেখি।"

 

আমি বললাম ক্লাস না হয় ফ্রী করলা কিন্তু থাকা খাওয়ার খরচ তো আর ফ্রিতে পাওয়া যাবে না। ছেলেটা আমার উত্তরে একটা রহস্যময় হাসি দিল।

 

শুক্রবার ছুটির দিনে শ্যামলী গার্ডেন স্টিটের একটা বাড়ীর সামনে ছেলেটার সাথে দেখা করতে গেলাম।

 তার হাতে সময় খুবই কম ছিল। মেইন রোডে এসে যে চা খাবো সেই উপায়ও নেই। তার হাতে একটা চিরকুট টাইপের কাগজ ছিল।

আমি ছেলেটাকে চা খাওয়ানোর জন্য জোর করতে এক সময় ছেলেটা আমাকে তার হাতে থাকা ছোট কাগজটা দেখিয়ে বলল "আপনার সাথে দেখা করার জন্য ২০ মিনিটের জন্য ছুটি নিয়েছি।

 আজকে আর চা খাওয়ার সুযোগ হবে না। আরেকদিন খাবো ইনশাল্লাহ।"

 

ছেলের কথা শুনে আশেপাশে তাকালাম। কোথাও কোন কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম না।

এই এলাকায় কোনো কোচিং সেন্টারও থাকে না। পুরাটাই আবাসিক এলাকা, ছাত্র হোস্টেল থাকলেও সেটা একেবারেই নগণ্য।

ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম "কার কাছ থেকে ছুটি নিছ? কোথায় তোমার কোচিং সেন্টার?"

 

ছেলেটা বলল "এই গলিতেই আমি থাকি। এটাই একটা কোচিং সেন্টার।

এটা সম্পূর্ণ আবাসিক কোচিং সেন্টার। কেউ এখানে ভর্তি হলে তাকে থাকতে হয়।

 এখান থেকে বের হওয়া যায় না। মোবাইল ইউজ করা যায় না। দিনের নির্দিষ্ট সময় কিছুক্ষণের জন্য মোবাইল ইউজের অনুমতি দেয়া হয়।

 গেস্ট আসলেও দেখা করা যাবে না। কাউকে এই কোচিং সেন্টারের ঠিকানা দেয়া যাবে না।"

 

আমি বুঝলাম কোচিং সেন্টারটা খুবই ভালো। ছাত্রদেরকে একটা নিয়ম নীতির মধ্যে এনে এদেরকে ১২/১৪ ঘন্টা পড়ালেখা করায়। বাসায় থাকলে কেউ এভাবে পড়ালেখা করে না।

কারো সাথে দেখা না করার বিষয়টা ও মোবাইল ফোনের সীমিত ব্যবহার সবই ভালো লেগেছে কিন্তু কোচিং সেন্টারের ঠিকানাটা দেয়া যাবে না কেন?

তাদের কি ছাত্র লাগবে না? নাকি তারা অটোমেটিক ছাত্র পেয়ে যায়? কিছু প্রশ্নের উত্তর সেদিন পেলাম না।

 

২ মাস পরে ছেলেটার সাথে আশুলিয়ায় আবার দেখা হলো। শ্যামলীর কোচিং এর আপডেট জানতে চাইলাম।

ছেলেটা বলল "এটা কোচিং সেন্টার না, ঐটা একটা জেলখানা। আমি ৩ সপ্তাহ পরে ঐখানে থেকে চলে আসছি। আমাকে দিয়ে এত পড়ালেখা হবে না।"

 

ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম "তোমার সেই কোচিং সেন্টারের নাম কী?"

"শিবিরের কোচিং সেন্টার এটা" ছেলের উত্তর শুনে টাস্কি খেলাম।

"শিবিরের কোচিং? মানে কী?"

মানে হলো দেশব্যাপী শিবিরের কিছু কোচিং সেন্টার আছে যেগুলো ওপেন যেমন রেটিনা, ফোকাস, প্রবাহ ইত্যাদি।

 সেখানে টাকা দিয়ে সবাই পড়ালেখা করতে পারে। আর কিছু কিছু কোচিং সেন্টার আছে যেগুলোতে টার্গেট করে শুধুমাত্র শিবিরের সাথী সদস্যদেরকে পড়ানো হয়। সাথী/সদস্য হলো শিবিরের শপথের কর্মী।

 এরা দলের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে। মূলত এরাই দলের প্রাণ। এদেরকে বিভিন্ন ভার্সিটিতে ভর্তি করানোর জন্য শিবির কিছু 'আয়নাঘর' বানিয়েছে যেখানে শুধুমাত্র বাছাই করা শিবির পড়বে।

সেই 'আয়নাঘরে' একবার ঢুকবে আর কোর্স শেষে বের হবে। মাঝে কোনো ছুটি ছাটা নেই।

 এখানে কওমী মাদ্রাসা স্টাইলে রাত ৩ টায় ঘুম থেকে উঠিয়ে পড়ালেখা করানো হয়। অবশ্য তার আগে তাহাজ্জুদ পড়ানো হয়।

এরপরে সারাদিন বিভিন্ন পাঠ কার্যক্রম চলে। দুপুরে রেস্ট/ঘুম, বিকালে ইন্ডোর গেইম, এভাবে রাতে শোয়ার আগ পর্যন্ত পড়ালেখা করানো হয়।

কখনো মেডিকেল, কখনো ইঞ্জিনিয়ারিং, কখনো সেনাবাহিনীর আইএসএসবি, কখনো বিসিএস, কখনো বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য একেকজনকে নির্দিষ্ট সময় (কয়েক মাস) আয়নাঘরে থাকতে হয়।

 

এই আয়নাঘরে প্রতিদিন স্ক্রিনিং করা হয়। পড়ালেখার চাপ সহ্য করতে না পারলে তাকে রিজেক্ট করা হয়।

আমি যে ছেলেটার কথা বলেছিলাম ছেলেটা ভর্তি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এডমিশন কোচিং এ।

৩ মাসের কোর্স করার কথা, চাপ সহ্য না করার কারণে সে দেড় মাসের মাথায় সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত যারা টিকে তাদের লেখাপড়ার ক্যারিয়ার অনেক ভালো হয়।

 

২০১৩ সালের পরে জামায়াত শিবির বুঝতে পেরেছিল রেজিম অনেকদিন টিকে যাবে আর এই রেজিমের সবচেয়ে বড় খুঁটি হলো সেনাবাহিনী ও বিসিএস ক্যাডার বাহিনী।

শিবির তখন থেকে মাঠে নামতে পারত না, ওপেন রাজনীতি করতে পারত না। ফলে তাদের বিরাট সময় বেঁচে যেত। 

তখন থেকে তারা ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অনেকগুলো আয়নাঘর বানিয়েছিল যাতে অনেক শিবির কর্মী ট্রেনিং নিয়েছিল।

---

 

এই হলো শিবিরের আয়নাঘরের কাহিনী। 


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments