পৃথিবীতে মানব জাতির গোড়াপত্তনের শুরু থেকেই গল্পের ভাবনা শুরু হয়। প্রতিটি মানুষের জীবন এক-একটি বড় গল্প; জীবনের প্রতিটি বাঁক এক-একটি গল্পের প্লট। জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা, উত্থান-পতন, চিন্তা-চেতনা, অজানা-কৌতুহল, চাওয়া-পাওয়া, জীবন-জীবিকা, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদির মিলিত রুপ-ই গল্প। যে জীবনটাতে বৈচিত্র যত বেশি থাকে সে গল্পের গাঁথুনি তত মজবুত হয়, অলঙ্কার সমৃদ্ধ হয়। পাশাপাশি মানুষের জীবন-ভাবনার সাথে যোগ হয় প্রকৃতি, পরিবার, সমাজ, গোত্র, জাতি, ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার। অজানা আর কৌতুহল থেকে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন কল্প কাহিনী ও ভৌতিক চরিত্রের। আর এ সবগুলো মানব চরিত্রের সাথে মিশে বিভিন্ন ফ্লেভার যুক্ত করে অসংখ্য গল্পের জন্ম দেয়। সভ্যতার বিকাশের আগ পর্যন্ত এসব গাল-গল্প মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হত। মানুষ লেখতে শেখার সময় থেকে গল্পগুলো লেখ্য রীতিতে স্থানান্তর শুরু হয়; যার ফলশ্রতিতে গল্প এখন কথা সাহিত্যের অন্যতম অধ্যায় হিসাবে প্রচলিত।
পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোতে অনেক দিন থেকে গল্প লেখার প্রচলন শুরু হয়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় শিল্প-সাহিত্যের চর্চা সবচেয়ে বেশী হতো বলে সেখানে গল্প লেখার প্রচলনও সর্বপ্রথম শুরু হয়। অন্যন্য উল্লেখযোগ্য প্রাচীন সভ্যতা গুলো হলো- ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, হিব্রু সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা এবং ইনকা সভ্যতা।
বাংলা কথা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা হলো ছোট গল্প। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলা সাহিত্যে এ ধারাটি সংযুক্ত হয়। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা ছোট গল্পের জনক বলা হয়। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রণাথ ঠাকুর হলেন বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যের ছোট গল্পের অন্যতম "কথা শিল্পী"।
ছোটগল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "বর্ষাযাপন" কবিতায় বলেছেন-
"ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অকালের জীবনগুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল।"
ছোটগল্পের কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- এর ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে বৃহতের ইঙ্গিত থাকবে; এর আরম্ভ ও উপসংহার হবে নাটকীয়; এর বিষয়বস্তু সাধারণত স্থান, কাল ও ঘটনার ঐক্য মেনে চলবে; এতে মানবজীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত, ভাব বা চরিত্রের একটি বিশেষ দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে; যেকোনো ধরনের বাহুল্য বর্জনের মাধ্যমে গল্পটি হয়ে উঠবে রসঘন; এতে থাকবে রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত ইত্যাদি। সর্বোপরি গল্প সমাপ্তির পরেও পাঠকের মনের মধ্যে এর গুঞ্জরণ চলতে থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় বলতে পারি, "শেষ হয়েই হইল না শেষ"। এমনটি হলেই তা স্বার্থক ছোটগল্পে পরিণত হবে।
ছোটগল্পের সংজ্ঞা নিয়ে সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকের মতে, যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দুই ঘন্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাই ছোট গল্প। তবে বেশিরভাগ আধুনিক কথা সাহিত্যিকদের মতে, ছোটগল্প ১০ থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্চনীয়। বিশ্ব বিখ্যাত আমেরিকান গল্পকার ''এডগার এলান পো'' (Edgar Allan Poe) ছোট গল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, A short story should be read in one sitting; anywhere from a half hour to two hours.
বাংলা ছোটগল্পের স্বার্থক রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ''ঘাটের কথা'' ছোটগল্পটি বাংলাভাষার প্রথম সার্থক ছোটগল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে। অতঃপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়), বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, জগদীশ গুপ্ত, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, মনোজ বসু প্রমুখের রচনা নৈপুণ্যে বাংলা ছোটগল্প নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে।