প্রযুক্তির মেলা।

Comments · 4 Views

আগের দিনের চিঠির গুরুত্ব এখানকার মানুষ বুঝবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে নিজের রুমে বসে মিলি তখন পড়ায় ব্যস্ত। রাত দুটো বেজে গেছে তার খেয়ালই নেই।

 হঠাৎ ঘন্টার আওয়াজে খেয়াল হলো। কাল অনার্স ফাইনালের শেষ পরীক্ষা। ভাবলো এবার টেবিল লাইটটা নিভিয়ে শুয়ে পড়া ভাল।

রুমের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মিলি টেবিল ছেড়ে উঠতেই শুনলো দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে।

তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলতেই লিমা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে ওর চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়লো। মিলি তাকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সে অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে লিমা আর মিলি প্রানের বান্ধবী। একই হলে থাকলেও তাদের রুম আলাদা।

ঘুমের সময়টুকু ছাড়া দুজনে সারাদিন একসঙ্গেই কাটায়। দিনাজপুরের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে বড় হয়েছে লিমা। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী সে।

এসএসসি ও এইচএসসি দুটোতেই স্ট্যান্ড করে। নিজের স্কলারশিপের টাকায় সে এখানে পড়াশোনা করে। মামাবাড়িতে মানুষ হয়েছে। মা ছাড়া আপন বলতে তার কেউ নেই। 

কাঁদতে কাঁদতেই লিমা বললো, মা হার্ট এটাক করেছে। আমাকে কেউ কিছু বলছে না। শুধু বলছে বাড়ি আয়। মাসের শেষ।

আমার কাছে টাকাও নেই। কাল আমার শেষ পরীক্ষা। আমি এখন কি করবো। 

সময়টা ১৯৯৯ সাল। তখন হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না। লাখ টাকা দিয়ে যারা মোবাইল কিনতে পারতো শুধু তাদের হাতেই ফোন থাকতো।

বাড়ির সাথে যোগাযোগের উপায় এক চিঠি, না হয় ফোন-ফ্যাক্সের দোকানের ল্যান্ড ফোন। আর সেটাও নির্দিষ্ট সময় ছাড়া সম্ভব নয়। 

মিলির একজোড়া সোনার ঝুমকা আছে। র‍্যাগ ডে এর অনুষ্ঠানে পরার জন্য বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল।

 মিলির মা এটা মিলির বিয়ের জন্য গড়িয়ে রেখেছে। ঝুমকাটা অনেক ভারি এবং সুন্দর। অনেকখানি সোনা দিয়ে গড়া। মিলিদের পরিবারের অর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল, তবে প্রাচুর্য নেই।

মিলি ঝুমকাজোড়া লিমাকে দিয়ে বললো, ভোরেই রওনা হয়ে যা। পরীক্ষা পরের বছর দিস। লিমার যাওয়ার ভাড়াটাও মিলি দিয়ে দিল। একটা বছর নষ্ট করা লিমার জন্য খুব কঠিন ব্যাপার।

তা সত্ত্বেও সে ভোর না হতেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কারণ মা তার জীবনের সব। সে যে আজ এই পর্যন্ত এসেছে তা শুধু তার মায়ের জন্য।

অনার্স পরীক্ষা শেষ। তারপর আরও কয়েক মাস কেটে গেছে। অনার্সের রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে।

কিন্তু লিমার সাথে আর কোন যোগাযোগ করা যায় নি। তার মা কেমন আছে সে খবরটাও পাওয়া যায় নি। এর মধ্যে মিলির দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার একটা সুযোগ এসে যায়।

 সে আর এখানে মাষ্টার্সে ভর্তি হয়নি। মিলির সাথে লিমার আর কোনদিন দেখা হয়নি।

 

চাকরির ইন্টারভিউ দিতে রুমে ঢুকলো লিমা। বোর্ডে পাঁচজন সদস্য বসেছেন। দুজন মহিলা তিনজন পুরুষ।

লিমার পরনে একটা অফহোয়াইট জামদানী শাড়ী। লম্বা কোকরানো চুলগুলো ডান কাঁধের উপর দিয়ে সামনে এনে রেখেছে। খুবই মার্জিত সাজগোজ। তবুও পাঁচজনেরই দৃষ্টি তার কানের দিকে।

লিমার বাম কানে একটা বড় সাইজের সোনার ঝুমকা ঝুলছে। অন্য কানটা খালি। লিমা একটা চেয়ারে বসার পর প্রশ্নকর্তার প্রথম প্রশ্ন, আপনি বোধ হয় খেয়াল করেন নি, আপনার একটা দুল বোধ হয় কোথাও পড়ে গেছে। 

লিমা একটুও বিচলিত না হয়ে বললো, কোথাও পড়ে যায় নি। আমি সচেতনভাবেই একটা দুল পড়েছি।

ও আচ্ছা, কারণটা জানতে পারি?

কারণটা ব্যক্তিগত। 

কথায় আছে, আগে দর্শনদারী তারপর গুন বিচারী। আপনি বিষয়টাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

এই প্রশ্নের উত্তরটাকি আমার এই পোস্টের জন্য খুব জরুরি? 

জরুরি তো বটেই। আপনি ব্যাংকের একটা দায়িত্বশীল পোস্টে থাকবেন। আপনাকে দেখে গ্রাহকের মনে হতেই

 পারে আপনি নিজের জিনিসই ঠিকমতো সামলাতে পারেন না, এত টাকার লেনদেন আপনি কিভাবে সামলাবেন।

এই পোস্টের জন্য আপনারা কমপক্ষে পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা চেয়েছেন। আমি এখন যেখানে কাজ করি সেখানে আমার চাকরির বয়স আঠারো বছর।

 আমি যে সেখানে সুনামের সাথেই কাজ করছি সেই খোঁজও আপনারা নিয়েছেন আমার রেফারেন্স থেকে। কাজেই গুন যে আমার আছে সেটা বিচারের অপেক্ষা রাখে না। আর রইলো দর্শনদারী।

 এমনতো কত সময়েই হয়, বাজার থেকে পেয়ারা কেনার সময় আমরা চকচকে দেখে কিনে আনি। কিন্তু কাটার পর দেখা যায় পুরোটাই পোকায় খাওয়া।

 তখন তো সেটা ফেলেই দিতে হয়। কোন কাজে আসে না। আপনি কি দেখতে সুন্দর অথচ কাজে দক্ষ নয় এমন কাউকে কাড়ি কাড়ি টাকা বেতন দিয়ে রাখবেন? আপনিতো দক্ষতা যাচাই করতেই আমাদের ডেকেছন।

রুমের পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য অন্য একজন প্রসঙ্গটা টেনে নিয়ে বললেন, আপনি খামোখাই উত্তেজিত হচ্ছেন ম্যাডাম। আমার মনে হয় এর পিছনে অন্য গল্প আছে। আমরা সেই গল্পটাই শুনতে চাইছি।

হয়তো সেখান থেকে আমরা আপনার ব্যাক্তিত্বের পরিচয়ও পেতে পারি। আপনার যোগ্যতাতো সিভিতেই স্পষ্টভাবেই দেয়া আছে।

গল্পতো একটা আছেই। গল্পটা হলো বন্ধুত্বের। গল্পটা ভালবাসার। আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার আগের দিন আমার মায়ের হার্ট এটাক হয়।

আমি পরীক্ষা না দিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। আমার মায়ের দ্রুত সার্জারির প্রয়োজন পড়ে। আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী আমাকে সেদিন এক জোড়া ঝুমকা দিয়েছিল।

আমি এর একটা বিক্রি করে মায়ের হার্টের চিকিৎসা করাই। আমরা খুব গরীব ছিলাম। আমার জন্য মা আর মায়ের জন্য আমি ছাড়া আমাদের আর কেউ ছিল না। মামার আশ্রয়ে থাকতাম আমরা। মামা আমাদের খুব ভালবাসতেন।

বাবার মতোই আগলে রেখেছিলেন। কিন্তু মামারও খুব টানাটানির সংসার ছিল। তাাই মা খুব আশা করে ছিলেন কবে আমি পাস করে বের হব আর কবে আমার চাকরি হবে। কিন্তু পরীক্ষাটা সেবছর আমি দিতে পারিনি মায়ের অসুস্থতার জন্য।

অপারেশনের পরও মাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাতে হয়েছে। আমি তখন টিউশনি করে, ধার করে মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাই। আজ আমার মা সুস্থ শরীরে ঘুরে ফিরে বেড়ায় শুধু আমার বান্ধবীর জন্য।

জানি না ওর মাকে ও কি জবাব দিয়েছিল ঝুমকোজোড়ার জন্য। পরের বছর আমি অনার্স পরীক্ষা দেই। রেজাল্ট বের হওয়ার সাথে সাথেই আমি ভাল একটা চাকরি পেয়ে যাই।

তখন থেকেই আমি আর মা একসাথে থাকি। আমার প্রথম ইন্টারভিউয়ের দিনও আমি এই দুলটা পরেছিলাম। এটা আমার লাকি চার্ম।

আজ প্রযুক্তির যুগে এসেও আমি আমার প্রিয় বান্ধবীকে এখনো খুঁজে পাইনি। যদি কোনদিন তার সাথে আমার দেখা হয় আমি তাকে অবিকল ঝুমকোজোড়া গড়ে দেব। 

লিমা যখন কথাগুলো বলছিল তখন রুমেই একজন বসে পুরোটা মোবাইলে ভিডিও করছিল। গল্পের শুরুটা তার খুব চেনা। খুব প্রিয় একজনের মুখে এই গল্প সে বহুবার শুনেছে।

এই চাকরিটাও লিমার হয়ে গেছে। আজ তার নতুন অফিসে প্রথমদিন। আজও লিমা একটা জামদানী শাড়ী পরেছে হালকা বেগুনি রংয়ের।

কোকরানো চুলগুলোকে ডান কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে এনে রেখেছে। তার বাম কানে সেই ঝুমকোটা ঝুলছে। মার্জিত ও স্নিগ্ধ সাজে তাকে অপূর্ব দেখতে লাগছে। সহকর্মীরা তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানালো।

লিমা হাসিমুখে তাদের অভ্যর্থনার জবাব দিল। তারপর গেল ম্যানেজারের রুমে। ম্যানেজার ভদ্রলোকটি অত্যন্ত সুপুরুষ এবং অমায়িক। ইন্টারভিউ বোর্ডে লিমা তাকে দেখেছে।

রুমে ঢুকতেই লিমা দেখলো ম্যানেজারের রুমে একজন ভদ্রমহিলা তার দিকে পিছন করে ম্যানেজারের মুখোমুখি একটি চেয়ারে বসে আছে। তাই অনুমতি নিয়েই লিমা রুমে প্রবেশ করলো।

 ম্যানেজার যেন লিমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। কারণ যে অভাবনীয় মুহূর্তটি এখন তৈরি হবে তা তিনি স্বচক্ষে দেখতে চান। লিমা রুমে প্রবেশ করতেই পিছন ফিরে বসে থাকা ভদ্রমহিলাটি উঠে দাঁড়ালেন।

লিমার সাথে তার দূরত্ব এক হাত মাত্র। ভদ্রমহিলা ঘুরতেই লিমার মুখোমুখি হলেন। সঙ্গে সঙ্গে লিমার চোখদুটো বিস্ফোরিত হল। সেই চোখে বিষ্ময়, আনন্দ, আবেগ মিলে মিশে একাকার।

দেড় যুগ পরে লিমা আর মিলির দেখা হলো। কে আগে কথা বলবে, কে আগে জড়িয়ে ধরবে এটা ভাবতে ভাবতেই কয়েক মিনিট কেটে গেল। 

চারদিকে কেবলই মোবাইল ক্লিকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যুগটা যে প্রযুক্তির।

Comments
Read more