ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক ছিলেন আইয়ুব (আ.)। বছরের পর বছর শারীরিক ও আর্থিক কষ্টে ভুগেও মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞ ছিলেন তিনি।
পবিত্র কোরআনে চারটি সুরার আটটি আয়াতে আইয়ুব (আ.)-এর কথা এসেছে। যথা- সুরা : নিসা, আয়াত : ১৬৩, সুরা : আনআম, আয়াত : ৮৪, সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৩-৮৪ এবং সুরা : সাদ, আয়াত : ৪১-৪৪।
কোরআন থেকে শুধু এতটুকু জানা যায় যে তিনি কোনো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে সবর করে যান এবং অবশেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করে রোগ থেকে মুক্তি পান।
এই অসুস্থতার দিনগুলোতে তাঁর সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব সবাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। এরপর আল্লাহ তাআলা তাকে সুস্থতা দান করেন।
মহান আল্লাহ তাঁকে সন্তান ও সম্পদ দিয়েছিলেন, অসুস্থতার পাশাপাশি সেগুলোও ছিনিয়ে নেন।
কিন্তু তাঁর স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত স্বামীভক্ত। তিনি সারাক্ষণ তাঁর সেবা করতেন। এমনকি একপর্যায়ে পরিবারের খরচ মেটাতে তিনি অন্য মানুষের বাসায় কাজ করতেন। অন্যদিকে ধীরে ধীরে রোগ-ব্যাধি, দুঃখ-কষ্ট বাড়তে থাকে আইয়ুব (আ.)-এর।
বিপদ যত বাড়ে, তিনি তত বেশি আল্লাহকে ডাকতে থাকেন, যেভাবে শীত যত বাড়ে মানুষ তত বেশি শীতবস্ত্র দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখে। আল্লাহর জিকির দিয়ে তিনি তাঁর দেহ ও অন্তর তরতাজা রাখেন।
বিপদে ধৈর্য ধারণ এবং আল্লাহর পরীক্ষা হাসিমুখে বরণ করে তিনি ‘সবরকারী’ ও ‘চমৎকার বান্দা’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর ধৈর্যের পরম পরাকাষ্ঠা দেখে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি (আল্লাহ) তাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পেয়েছি।’ (সুরা : সাদ, আয়াত : ৪৪)
বছরের পর বছর তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে সন্তানহীন, সঙ্গীহীন ও সম্পদহীন হয়ে কোনো এক প্রান্তরে একান্তে অবস্থান করেন।
আর মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন। তাঁর দোয়ার ভাষ্য কোরআনে এভাবে এসেছে : ‘আর স্মরণ করো আইয়ুবকে, যখন সে তার রবকে ডেকেছিল, (বলেছিল) আমি তো দুঃখ-কষ্টে পড়েছি (দুঃখ-কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে), আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৩)
দোয়ার ধরন অত্যন্ত নমনীয় ও মার্জিত; যথাযথ আদব ও শিষ্টাচারপূর্ণ। নেই অভিযোগ, নেই অনুযোগ। ‘কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে’—কঠিন বিপদেও মধুময় আবেদন। আবেদনের ভেতর ভাব আছে, মর্মস্পর্শী আবেগ আছে, আছে কষ্টের কথাও।
তবু কোনো আবদার নেই, চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু এ কথা বলে থেমে যাচ্ছেন : ‘আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’
আল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো নালিশ নেই, কোনো জিনিসের দাবি নেই। তাতেই খুশি হয়ে মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। তাঁর দোয়া কবুল করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম।
আর তার যত দুঃখ-কষ্ট ছিল তা দূর করে দিলাম এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে দিয়ে দিলাম। তাদের সঙ্গে তাদের মতো আরো দিলাম আমার পক্ষ থেকে রহমত এবং ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৪)
কিভাবে দূর হলো অসুখ—সে বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘(আমি তাকে বললাম,) তুমি তোমার পা দিয়ে (ভূমিতে) আঘাত করো। (ফলে পানি নির্গত হলো এবং দেখা গেল যে) এটি গোসলের জন্য ঠাণ্ডা পানি ও (পানের জন্য উত্তম) পানীয়।’ (সুরা : সাদ, আয়াত : ৪২)
এটি ছিল অলৌকিক ঝরনা। ইতিপূর্বে শিশু ইসমাঈল (আ.)-এর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। তাঁর পদাঘাতে জমজমকূপ তৈরি হয়েছিল। এটা নবীদের মুজিজা।
এটা নবীদের বরকত। নবী-রাসুলদের পদতলে মহান আল্লাহ বরকত ঢেলে দেন। সেই বরকত থেকে সিক্ত হয় প্রকৃতি ও পৃথিবী। এই বরকতের পানি দিয়ে আইয়ুব (আ.) গোসল করেন। তিনি সুস্থ হয়ে যান। একে একে সম্পদ ফিরে পান এবং সন্তান লাভ করেন।
আইয়ুব আলাইহিস সালাম তাঁর প্রাকৃতিক কাজ সারতে বের হতেন। কাজ সারার পর তাঁর স্ত্রী তার হাত ধরে নিয়ে আসতেন। একদিন তিনি প্রাকৃতিক কাজ সারার পর স্ত্রীর কাছে ফিরতে দেরি করছিলেন। আগমনে দেরি দেখে স্ত্রী এগিয়ে যান।
ততক্ষণে অলৌকিক ঝরনায় গোসল করে আইয়ুব (আ.) সম্পূর্ণ সুস্থ ও সুন্দর হয়ে যান। তাঁর স্ত্রী তাকে দেখে বলেন, হে মানুষ, আল্লাহ আপনার ওপর বরকত দিন, আপনি কি ওই অসুস্থ আল্লাহর নবীকে দেখেছেন?
আল্লাহর শপথ, যখন তিনি সুস্থ ছিলেন তখন তিনি দেখতে আপনার মতো ছিলেন। তখন আইয়ুব (আ.) বলেন, আমিই সেই ব্যক্তি। এভাবে তিনি সুস্থ হন।
আইয়ুব (আ.)-এর দুটি উঠান ছিল। একটি গম শুকানোর, অন্যটি যব শুকানোর। মহান আল্লাহ সে দুটির ওপর দুই খণ্ড মেঘ পাঠালেন।
এক খণ্ড মেঘ সে গমের উঠানে এমনভাবে স্বর্ণ ফেলল যে সেটি পূর্ণ হয়ে গেল। অন্য মেঘ খণ্ডটি সেটির ওপর এমনভাবে রৌপ্য বর্ষণ করল যে সেটাও পূর্ণ হয়ে গেল। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ২৮৯৮, মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদিস : ৪১১৫)
এভাবে সোনা-রুপায় দানায় তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক হয়ে যান। হাদিসের বর্ণনা থেকে আরো জানা যায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে স্বর্ণের পঙ্গপাল আইয়ুব (আ.)-এর কাছে আসে।
তিনি সেগুলো সংগ্রহ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একবার আইয়ুব (আ.) কাপড় খুলে (অর্থাৎ বাথরুম ছাড়াই খোলা স্থানে) গোসল করছিলেন, এ অবস্থায় একঝাঁক স্বর্ণের পঙ্গপাল তাঁর ওপর পড়তে শুরু করে,
তিনি সেগুলো মুঠি মুঠি তার কাপড়ে জমা করছিলেন। তখন মহান আল্লাহ তাঁকে ডাক দিয়ে বলেন, হে আইয়ুব, আমি কি তোমাকে যা দেখছ তা থেকেও বেশি দিয়ে ধনী বানাইনি?
জবাবে আইয়ুব (আ.) বলেন, ‘ইয়া রাব্বি, লা গিনা বি আন বারাকাতিকা (অর্থ : হে রব, তবে আপনার দেওয়া বরকত থেকে আমি কখনো মুখাপেক্ষীহীন হবো না।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৯৩)
পুরো ঘটনা থেকে জানা যায়, বড় পরীক্ষায় আছে বড় পুরস্কার। সম্পদ ও সন্তান হারিয়ে কঠিন অসুস্থ হয়েও জিকির, ইবাদত ও আমল থেকে বিচ্যুত হননি আইয়ুব (আ.)।
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হননি। মার্জিত ভাষায় অভিযোগহীন, বিরামহীন তিনি দোয়া করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। সবরের ফল দুনিয়ায় দিয়ে দেন। সুস্থতা, সম্পদ ও সন্তান—সব কিছু ফিরিয়ে দেন।
মুমিনদের জন্য এই ঘটনায় আছে বিশেষ বার্তা।