আমি একজন এডভোকেট। আমার স্বামী ব্যবসায়ী। বিয়ের এক বছরের মাথায় জানতে পারলাম সে অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িত।
তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেসা করলে সে অস্বীকার করলো।
বললো, "এসব বাজে কথা। কোনো মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক নেই।"
বললাম,"অভিনয় করে পার পাবে না। ব্যাপারটা সত্য না মিথ্যে তুমি ভালো করেই জানো।"
"জানি বলেই তো বলছি এসব মিথ্যে। যাদের কাছ থেকে এসব জেনেছো, তারা তোমার ভালো চায় না।"
"তোমাকে বিনীত অনুরোধ করবো এসব থেকে ফিরে এসো।"
"কী আজেবাজে বকছো! কীসের থেকে ফিরে আসবো? আমি এমন কিছু করি নি যে, ফিরে আসতে হবে।"
আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, সে মিথ্যে বলছে।
বললাম, "বেশি চালাকি করো না। জানোই তো অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়ে।"
"এসব ফালতু বিষয়ে কথা বলার সময় আমার নেই। অনেক কাজ আমার।"
এই বলে সে বেরিয়ে গেলো।
এর দুদিন পর যে মেয়েটির সাথে ও সম্পর্কে জড়িয়েছে, তার কাছে গেলাম। মেয়েটি অবিবাহিতা। মাস্টার্সে পড়ছে।
মেয়েটির সাথে দেখা করি ওর ভার্সিটিতে গিয়ে।
প্রাথমিক কিছু কথা বলার পর মেয়েটিকে সরাসরি বললাম, "আপনি যে পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন, আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী। বছর খানেক হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। ও যে বিবাহিত সেটা কি আপনি জানেন?"
আমার কথা শুনে মেয়েটি চমকালো না।
সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, "আপনি ভুল করছেন। বিবাহিত পুরুষ তো দূরে থাক, কোনো অবিবাহিত পুরুষের সাথেও আমার কোনো সম্পর্ক নেই।"
মেয়েটির উত্তর শুনে বুঝলাম আমার স্বামী মেয়েটিকে আগে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছিলো।
বললাম, "ধোঁকাবাজের সঙ্গে সংসার করে তো সুখী হবেন না। আমার স্বামী যে ধোঁকাবাজ, চরিত্রহীন, এটা কি এখনো বোঝেন নি? ও আজ আমার সাথে ধোঁকাবাজি করছে, কাল যে আপনার সাথে করবে না তার নিশ্চয়তা কি?"
মেয়েটি ব্যস্ততার ভান করে বললো, "আমাকে এখন যেতে হবে। আপনার এসব উদ্ভট কথা শোনার সময় আমার নেই।"
মেয়েটি যখন চলে যাচ্ছিলো তখন পেছন থেকে বললাম, "আপনি ভুল করছেন। বিরাট ভুল করছেন।"
কোনো কথা না বলে মেয়েটি দ্রুত হেঁটে চলে গেলো।
এই ঘটনার তিন মাস পর আমার আর আমার স্বামীর মধ্যে তিক্ততার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে, আমাদের বিয়েটা ভেঙে গেলো। আর তারপরই আমার স্বামী মেয়েটিকে বিয়ে করলো।
বাবার বাড়িতে দিন কাটতে লাগলো। দিনের বেলায় কোর্টে থাকি আর রাতে পড়াশোনা করি।
এই সময় এক প্রাইভেট কোম্পানির কর্মকর্তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এবং দ্রুত সেটা গভীর হয়ে উঠলো। লোকটি বিয়ে করেছিলো। কিন্তু প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রী মারা যায়। সন্তানটিও বাঁচে নি। আমার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কথা সে জানতো। আমিই বলেছিলাম।
আমাদের বিয়েটা যখন নিশ্চিত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তখন একদিন আমার সাথে দেখা করার জন্য একজন মহিলা এলো। আমার বাড়িতেই এলো।
মহিলা যে কথাগুলো বললো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।
সে চোখের পানি ফেলে বললো, "আপনি কেনো আমার সংসার ভেঙে দিতে চাইছেন? কী অপরাধ করেছি আমি? কী অপরাধ করেছে আমার সন্তানেরা?"
তারপর মহিলা কাঁদতে কাঁদতে যা বললো, তাতে বুঝতে পারলাম, আমি যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম, সে একটা প্রতারক। তার স্ত্রী সন্তান আছে। অথচ সে আমাকে বলেছিলো, তার স্ত্রী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। সন্তানটিও বাঁচে নি।
দ্বিতীয়বারের মতো চরিত্রহীন পুরুষের সাথে সংসার করার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
মহিলাটিকে বললাম, "আপনার নাম কী?"
"আয়েশা।"
আমি তখন আমার মোবাইল থেকে আয়েশার স্বামীকে ফোন করলাম।
সে ফোন ধরেই উল্লসিত গলায় বললো, "তোমার বিয়ের শাড়ি কলকাতা থেকে কিনবো। বিয়ের সমস্ত কেনাকাটা ওখান থেকেই করবো।"
ওর কথার ধারে কাছে না গিয়ে শীতল কণ্ঠে বললাম, "আয়েশা নামের কাউকে চেনো?"
নামটি শুনে সে থতমত খেয়ে গেলো।
এবং আমতা আমতা করে বললো, "না তো।"
কথা না বাড়িয়ে মহিলাটিকে ফোন দিয়ে বললাম, "আপনার স্বামী। কথা বলুন।"
মহিলাটি ফোন কানে লাগিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বললো, "এতো বড়ো অন্যায় তুমি কী করে করতে পারলে? তোমার স্ত্রী ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও কী করে তুমি এমন করতে পারলে?"
এটুকু বলার পর মহিলা আর কিছু বলতে পারলো না। কারণ ও পাশ থেকে ফোন কেটে দেয়া হলো।
মহিলাটি কিছুটা স্থির হলে বললাম, "এই লম্পটের সাথে সংসার চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমি নিশ্চিত সামনে সে আরো মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করবে?"
মহিলাটি জানতে চাইলো, "আপনি তাহলে কী করতে বলছেন?"
"লম্পটটাকে শুধু তালাক দিলে হবে না। তাকে দিয়ে জেলের ঘানিও টানাতে হবে। আপনি শক্ত হন। আপনার সাথে আমি আছি। এই লম্পটগুলোর শিক্ষা হওয়া প্রয়োজন।"
মহিলাটি স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করলো। বিনা পারিশ্রমিকে আমি মামলাটি লড়লাম। যেহেতু এই মামলা আমারো মামলা।
লোকটির অপরাধ প্রমাণ করতে সমস্যা হলো না। আদালত থেকে লোকটিকে তিন বছরের জেল দেয়া হলো। আর মহিলাটিও লোকটিকে তালাক দিলো।
আদালতে রায় হওয়ায় পর মহিলাটি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো আনন্দে।
কয়েক বছর পরের ঘটনা। আইনজীবী হিসেবে আমি এখন প্রতিষ্ঠিত। বেশ নাম ডাক হয়েছে আমার।
এক রাতে আমার সাথে দেখা করার জন্য এক বয়স্ক মানুষ এলেন। তার মেয়ে স্বামী দ্বারা শারীরিক মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছে। তিনি মেয়ের জামাইয়ের উপযুক্ত শাস্তি চান।
তিনি বললেন, "শয়তানটা স্ত্রী সন্তান রেখে অন্য মেয়ের সাথে গোপন সম্পর্ক করেছে। আমার মেয়ে এর প্রতিবাদ করায় তার গায়ে হাত তুললো। বললো ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। মেয়েকে আমি নিয়ে এসেছি নাতি সহ। ঐ শয়তানটাকে আমি ছাড়বো না।"
বললাম, "কাল আপনার মেয়েকে নিয়ে আসবেন। ওর সাথে কথা বলা দরকার।"
পরদিন যে মেয়েটি দেখা করতে এলো তাকে দেখে আশ্চর্য হই নি। কারণ মেয়েটির জীবনে এমন কিছু যে ঘটবে তা ধারণা করেছিলাম। মেয়েটি আর কেউ নয়, আমার প্রাক্তন স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। যে মেয়েটিকে একদিন নিষেধ করেছিলাম আমার চরিত্রহীন স্বামীর সাথে সংসার করতে।
মেয়েটি মাথা নিচু করে আমার সামনে বসে রইলো। অপরাধী ভঙ্গিতে। সে এমন একজনের কাছে তার স্বামীর শাস্তির জন্য এসেছে যার সাথে সে নিজেই অন্যায় করেছে।
মেয়েটি মাথা নিচু রেখেই বললো, "আমি জেনেশুনে আপনার কাছে এসেছি। কারণ আপনার পক্ষে এই মামলা জেতা কঠিন নয়।"
একটু থেমে বললো, "অবশ্য আপনি চাইলে এই মামলা নাও নিতে পারেন। আমাকে সাহায্য না করার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে। অন্যায় তো আপনার সাথেও হয়েছে। আর সেজন্য আমিও দায়ী। সেদিন আপনার কথা না শুনে জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল করেছিলাম।"
মেয়েটির শাড়ির ওপর একটা চাদর জড়ানো ছিলো। সে ওটা সরিয়ে ওর পিঠ, বাহু দেখিয়ে বললো, "এই দেখুন ওর মারের দাগ। আপনার সাথে অন্যায় করার শাস্তি।"
বললাম, "সে এখন কোথায়?"
"মামলা করার পর পালিয়েছে।"
মেয়েটির শরীরের মারের কালচে দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম, "এই মামলা আমি নেবো।"
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।
আমার প্রাক্তন স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোর্টে মামলা চলতে লাগলো। সে দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলো। আদালতের রায় হওয়ায় মাস খানেক আগে সে গ্রেফতার হয়। কোর্টে যেদিন তাকে হাজির করা হয়, সেদিন ওকে দেখে বুঝলাম, আদালতের দেয়া শাস্তির আগেই তার শাস্তি শুরু হয়ে গেছে। তার শরীর ভেঙে গেছে। ব্যবসা নষ্ট হয়ে গেছে। চেনা অচেনা সবার কাছে সে এখন চরিত্রহীন হিসেবে পরিচিত।
আদালত তাকে সাত বছরের জেল দিলো। রায় হয়ে যাওয়ার পর কোর্ট থেকে পুলিশ যখন তাকে নিয়ে যাচ্ছিলো, সে তখন একবার আমার দিকে তাকালো। কী করুণ সে দৃষ্টি! যেনো একজন মৃত মানুষ আমার দিকে তাকালো। তখনই বুঝেছিলাম, এই আমাদের শেষ দেখা।
মাস চারেক পর একদিন রাতে বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ মা এসে বললেন,"শিহাব মারা গেছে। জেলখানাতে।"
শিহাব অর্থাৎ আমার প্রাক্তন স্বামী মারা গেছে।
মা আমার পাশে এসে বসলেন। পুরো বারান্দা ভরে আছে আমার লাগানো ফুলগাছে। সে ফুলের সৌরভ বুকে টেনে আমি মায়ের কাঁধে মাথা রাখলাম।