আরমান ভাই আমাদের মহল্লার একজন অতি জনপ্রিয়

ব্যক্তিত্ব। ড্রাইভারদের আড্ডা হোক কিংবা পাড়ার যুবসমাজের, অথবা আংকেলদের নীতি-রাজনীতি ভাবনায়,

আরমান ভাই আমাদের মহল্লার একজন অতি জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। ড্রাইভারদের আড্ডা হোক কিংবা পাড়ার যুবসমাজের, অথবা আংকেলদের নীতি-রাজনীতি ভাবনায়, আরমান ভাইকে পাওয়া যাবে না এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো – জ্ঞানের রাজ্যে তার অবাধ বিচরণ। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং হোক বা জেনেটিক, মাদক বা (সিনথেটিক/ভেষজ)  ঔষধ, খেলা বা রাজনীতি, নারী কিংবা ধর্ম – আরমান ভাই মিনি লেকচার দিতে পারবেন না (তা যতই ভুল তথ্য সম্বলিত হোক না কেন) এমন বিষয়ের আবির্ভাব সম্ভবত পৃথিবীতে আজও হয়নি। চুপ করে শুনে থাকতে পারবেন, এমন বিষয় খুঁজে পাওয়াই রীতিমত অসম্ভব। অন্তত এই ঈদের আগে আমাদের ধারণা তা-ই ছিলো।

 

ঈদের দিন থেকেই আরমান ভাইয়ের মেজাজ ভীষণ খারাপ। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, সাধারণত এসব পরিস্থিতিতে উদারচিত্তে গালি দেওয়ার বদঅভ্যাসের কারণে তার আশপাশে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়লেও আজ তার আচরণ এখনো আমাদের মোরাল/লিঙ্গুইস্টিক রেডিয়াস অতিক্রম করেনি। খুশিমনে এটাকেই আমরা তার ঈদের ট্রিট হিসেবে গণ্য করে নিলাম।

 

“বুঝলা… ইন্টারনেটে ঢুইকা মেজাজ ঠিক রাখা যায় না। কোরবানীর ঈদে তো আরো না। আজকালকার স্মার্ট পোলাপাইন সব দেখি ইব্রাহিম আলাইহিসসালামের লগে বাটপারি শুরু করসে।”

 

“কি করসে, ভাই?”

 

“আরে কিসব যে লিখে। একজন দেখলাম লিখসে, ‘গরুর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতেই তো গা শিউরে উঠছে। হয়তো কোন এক প্যারালেল ইউনিভার্সে আমরাই গরুদের লালসার শিকার হচ্ছি…’। আমিও কমেন্ট করছি –  অই ব্যাটা গরুর দালাল, অন্য ইউনিভার্সে কি আল্লাহ কোন গরুরে নবী হিসেবে পাঠাইসিলো নাকি? হালা নাস্তিকের… মানে, ন্যাস্টি ছেলে…”

 

আরমান ভাইয়ের এহেন পরিবর্তনে আমরা চরমভাবে বিস্মিত। গণহারে মানুষকে নাস্তিক ট্যাগ দেয়া ইদানিং তার হবিতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু এইমাত্র তিনি যেভাবে নিজেকে সামলে নিলেন, (তার মুখে ইংরেজি যতটা হাস্যকরই শোনাক না কেন) তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা তারপরও তাকে উসকে দেয়ার ভয়ে ব্যাপারটা সবাই একযোগে ওভারলুক করার চেষ্টা করলাম। আমাদের মধ্যে সবচাইতে নার্ড টাইপের ছেলে সাকিব (ফেসবুক নেইমঃ সায়েন্টিফিক সাকিব) স্বভাবসুলভভাবেই তার সায়েন্টিফিক উত্তর দিল – “একচুয়েলি, যেই ইউনিভার্সই হোক, গরু কখনও মানুষ ভক্ষণ করতে পারবে না। মানুষ কেন, গরু কোন প্রাণীই খেতে পারবে না। কারণ দাঁতের এরেঞ্জমেন্ট ও পরিপাকতন্ত্র বা ডাইজেস্টিভ সিস্টেম থেকে শুরু করে গরুর সব কিছুই শুধুমাত্র তৃণলতা ভোজের উপযোগী। কিন্তু মানুষের শরীরে শাকসবজি ও গোশত দুই পদের খাবারেরই চিবানোর ও হজম করার সুব্যবস্থা আছে। সুতরাং, আল্লাহর ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন আর্গুমেন্ট অনুযায়ীও মানুষের গরু ভক্ষণই স্বাভাবিক, গরুর মানুষকে ভক্ষণ করা নয়।”

 

আমাদের ছোটখাটো ঘুম ভাঙল আরমান ভাইয়ের উল্লসিত চিৎকারে।

 

“আমি জানতাম এটা সায়েন্টিফিকালিও প্রমাণ করা যায়… ওই যে যা যা বললা, ইন্টেলিজেন্ড ডিজাইন না কি, ওইটাই…”

 

“ভাই, লিজেন্ড না লিজেন্ট…”

 

“আরে ওই তো একই! আরেক বেধর্মী লিখসিলো, ‘কোরবানীর বর্জ্যের জন্য শহরে থাকাই বেসম্ভব ব্যাপার, আমি পার্সোনালি কোরবানী সাপোর্ট না করার অন্যতম কারণ এটা’। মেজাজটা যা বিগড়াইলো না! লেইখা দিসি – হালা তোর পার্সোনাল জিনিসপাতি প্রাইভেসি সেটিংস দিয়া পার্সোনালই রাখ, পাবলিক সেটিংসে রাখলে পাবলিকের মাইর খাবি… যতসব মালাউনের… মানে উমমম… মালালা… মালালা তো নোবেল পাইলো না, তাই না? মাইয়ার নামটাও যে কি রাখসে… নামেই লালা…”

 

তার আচমকা টপিক পরিবর্তনে আমরা সবাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। বুঝলাম, গালি দেয়া থেকে কন্ট্রোলে থাকতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

 

“জ্বি ভাই, পায় নাই। কি জানি বলতেসিলেন…”

 

“ও আচ্ছা, হ্যাঁ, যা বলতেসিলাম… কমেন্ট করতে গিয়াও আটকায় গেলাম। পোলা তো কথাটা ঠিকই বলসে। আসলেই তো অনেক নোংরা হয়া থাকে শহর। এটার জন্যই মেজাজটা আরো খারাপ হইলো। একটা জবাবও দিতে পারলাম না। আরো চিন্তা করলাম, এসব মানুষ আর আমগো সত্য ধর্ম বুঝবো ক্যামনে, আমরা নিজেরাই তো মানি না। ধর্ম ঠিকমত মানলে তো নিজ দায়িত্বেই পরিবেশের খেয়াল রাখতাম…”

 

“ঠিকই বলসেন ভাই।”

 

পরিস্থিতি অনুকূলে দেখে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাকিব বলে উঠলো, “ভাই, পরিবেশের সাথে সাথে আচরণও ঠিক করা দরকার। ইন ফ্যাক্ট, এটা আরো বেশি জরুরী কারণ ব্যবহারের ইম্প্যাক্ট আরো বড়। ইসলামের ইতিহাসে তো কেবল ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েই ইসলামে প্রবেশ করার অনেক নজির আছে। রসুলুল্লাহ (সাঃ) তো বলসেনই যে তাঁকে শুধুমাত্র আমাদের আচার-ব্যবহার পারফেক্ট করতে পাঠানো হইসে। এখন ধরেন কেউ একজন ইসলাম নিয়ে ভুল কিছু বলল, মুসলিম হোক বা অমুসলিম, ইন্টারনেটে বলুক আর সামনাসামনি। সে যত খারাপভাবেই বলুক না কেন, তাকে যদি গালাগালি করি বা অপমান করে কথা বলি, তাহলে প্রথমত আমরা নিজেরাই আল্লাহর রসূলকে অনুসরণ না করে নিজেদের ধর্ম মানতেসি না, ও দ্বিতীয়ত সেই মানুষটা ইসলাম থেকে আরো দূরে সরে যাবে। আমি চুপ করে থাকতে বলতেসি না, কিন্তু সমালোচনা কিংবা জবাবটা কি গঠনতান্ত্রিকভাবে, যুক্তিসহকারে ও সবচেয়ে উত্তম আচরণের মাধ্যমেই দেওয়া উচিত না? আমাদেরই দোষে একটা মানুষ ইসলাম থেকে দূরে সরে গেল, আল্লাহর জান্নাত থেকে দূরে সরে গিয়ে জাহান্নামের নিকটবর্তী হলো, এর দায় কি কিছুটা হলেও আমাদের ঘাড়ে বর্তাবে না?”

 

আমরা সবাই বিস্ফোরিত চোখে সাকিবের দিকে তাকিয়ে আছি। এত সাহস পাইলো কই ছেলেটা? এখনই তো আরমান ভাইয়ের মুখের বুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাবে, গালির বন্যায় ভেসে যাবে। তাকে ভাষাশহীদ হিসেবে মর্যাদা দেয়া যাবে কিনা চিন্তা করছি, এমন সময়ে আরমান ভাইয়ের সারপ্রাইজ অফ দ্য ইয়ার –

 

“হুম, কথায় দম আছে। যাইতে হইব এখন…”

 

এই বলেই তিনি আড্ডাস্থল ত্যাগ করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই হতবাক।

 

রাতে আরমান ভাইকে লিফটে পেয়ে সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম –

 

“ভাই, আজকে আপনার কথাবার্তার ফ্লেভার একটু ডিফারেন্ট লাগতেসিল…”

 

“ওহ খেয়াল করসস দেখা যায়। হ, কোরবানীর ঈদের ইন্সপিরেশনে একটু জবানের কোরবানী প্র্যাক্টিস করতাছি আরকি। নাইলে আমার যে তেজ, ওই লেকচারের পর আমি ওই মাদারচো… মাদার চরিত্রে তেরেসা যেমন অভিনয় করসিলো, সেইরাম অভিনয় দেখাইলাম ক্যামনে?”

 

কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। নোবেল মনোনয়নপ্রাপ্তদের কিঞ্চিৎ অসম্মান করলেও, আরমান ভাই আসলেই কোরবানীর শিক্ষা কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছেন।


Polok1559

22 Blog posts

Comments