হযরত আবু কাতাদাহ ! সেই এক দুর্দান্ত সাহসী যুবক!
৬ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে জিকারাদ বা গাবা অভিযান পরিচালিত হয়। সেই অভিযানে তিনি দারুণ দুঃসাহসের পরিচয় দান করেন।
হযরত রাসূলে কারীমের (সা) উটগুলো জিকারাদ নামক একটি পল্লীতে চরতো।
রাসূলুল্লাহর (সা) দাস রাবাহ ছিলেন সেই উটগুলোর দায়িত্বে। গাতফান গোত্রের কিছু লোক রাখালদের হত্যা করে উটগুলো লুট করে নিয়ে যায়। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সালামা ইবন আকওয়া এ সংবাদ পেয়ে আরবের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মদিনার দিকে মুখ করে শত্রুর আক্রমণের সতর্ক ধ্বনি ইয়া সাবাহাহ্! বলে তিনবার চিৎকার দেন। অন্য দিকে রাবাহকে দ্রুত রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পাঠিয়ে দিয়ে নিজে গাতফানী লুটেরাদের পেছনে ধাওয়া করেন।
হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে সাহায্যের জন্য দ্রুত তিনজন অশ্বারোহীকে পাঠিয়ে দেন এবং তাঁদের পেছনে তিনি নিজেও বেরিয়ে পড়েন।
সালামা ইবন আকওয়া মদিনার সাহায্যের প্রতীক্ষায় ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন, আবু কাতাদাহ আল-আনসারী, আল-আখরাম, আল-আসাদী এবং তাঁদের পেছনে মিকদাদ আল-কিন্দি বাতাসের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছেন।
এই অশ্বারোহীদের দেখে গাতফানীরা উট ফেলে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আল-আখরাম, আল-আসাদির মধ্যে তখন শাহাদাতের তীব্র বাসনা কাজ করছে।
তিনি সালামার নিষেধ অমান্য করে গাতফানীদের পিছে ধাওয়া করেন।
এক পর্যায়ে আবদুর রহমান আল-আখরামের ঘোড়াটি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। এমন সময় আবু কাতাদাহ এসে উপস্থিত হন এবং তিনি বর্শার এক খোঁচায় আবদুর রহমানকে হত্যা করেন।
কেউ বলেন, এই জিকারাদ যুদ্ধে আবু কাতাদাহ যাকে হত্যা করেন তার নাম হাবিব ইবন উয়াইনা ইবন হিসন।
তিনি হাবিবকে হত্যা করে নিজের চাদর দিয়ে লাশটি ঢেকে শত্রুর পেছনে আরও এগিয়ে যান।
পেছনের লোকেরা যখন দেখতে পেল, আবু কাতাদাহর চাদর দিয়ে একটি লাশ ঢাকা তখন তারা মনে করলো, নিশ্চয়ই এ আবু কাতাদাহর লাশ। সাথে সাথে তারা ইন্নালিল্লাহ উচ্চারণ করলো। তারা নিজেরা বলাবলি করতে লাগলো: আবু কাতাদাহ নিহত হয়েছে।
এ কথা শুনে রাসূল (সা) বললেন : আবু কাতাদাহ্ নয়; বরং আবু কাতাদাহর হাতে নিহত ব্যক্তির লাশ। সে একে হত্যা করে নিজের চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে, যাতে তোমরা বুঝতে পার, এর ঘাতক সেই।
আবু কাতাদাহ বলেন, জিকারাদের দিন অভিযান শেষে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে আমার দেখা হলে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে দু’আ করেন : হে আল্লাহ! তুমি তার কেশ ও ত্বকে বরকত দাও। তার চেহারাকে কামিয়াব কর।
আমি বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনার চেহারাও কামিয়াব করুন!
এ দিন তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতার বর্ণনা শুনে রাসূল (সা) মন্তব্য করেন : আবু কাতাদাহ আজ আমাদের সর্বোত্তম অশ্বারোহী।
হুদাইবিয়া সন্ধির সফরে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে আবু কাতাদাহও ছিলেন। এ সফরে ফেরার পথে একদিন রাসূলসহ (সা) সহ তাঁর সফর সঙ্গীদের ফজরের নামাজ কাজা হয়ে যায়। সে কাজা নামাজ কখন কিভাবে রাসূল (সা) আদায় করেছিলেন তার একটা বিবরণ আবু কাতাদাহ্ বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়।
হিজরি সপ্তম অথবা অষ্টম সনে রাসূল (সা) আবু কাতাদাহর নেতৃত্বে একটি বাহিনী ইদামের দিকে পাঠান।
এই ইদাম একটি স্থান বা একটি পাহাড়ের নাম এবং মদিনা থেকে শামের রাস্তায় অবস্থিত।
তাঁরা ইদাম উপত্যকায় পৌঁছানোর পর তাঁদের পাশ দিয়ে আমের ইবন আল-আদবাত আল-আশজায়ী যাচ্ছিলেন। তিনি আবু কাতাদাহ ও তাঁর বাহিনীর সদস্যদের সালাম দিলেন। তা সত্ত্বেও পূর্ব- শত্রুতার কারণে এ বাহিনীর সদস্য মুহাল্লিম ইবন জাসসামা ইবন কায়েস তাঁকে হত্যা করেন এবং তাঁর উট ও অন্যান্য জিনিস ছিনিয়ে নেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থিত হয়ে যখন তাঁকে এ ঘটনা অবহিত করেন তখন সূরা আন নিসার ৯৪ নং আয়াতটি নাযিল হয় – “হে মুমিনগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে যাত্রা করবে তখন পরীক্ষা করে নেবে। কেউ তোমাদেরকে সালাম দিলে ইহ-জীবনের সম্পদের আকাঙ্ক্ষায় তাকে বলো না, তুমি মুমিন নও। কারণ, আল্লাহর নিকট অনায়াসলভ্য সম্পদ প্রচুর আছে। তোমরা তো পূর্বে এরূপই ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সুতরাং তোমরা পরীক্ষা করে নেবে। তোমরা যা কর আল্লাহ সে বিষয়ে বিশেষভাবে অবহিত।”
হিজরি ৮ম সনের শাবান মাসে রাসূল (সা) নাজদের খাদরাহ্ নামক স্থানের দিকে ১৫ সদস্যের একটি বাহিনী পাঠান। আবু কাতাদাহ্ ছিলেন এই বাহিনীর আমীর।
সেখানে গাতফান গোত্রের বসতি ছিল। তারা ছিল মুসলমানদের চরম শত্রু এক লুটেরা গোত্র। তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল। এ কারণে সারা রাত চলতেন এবং দিনে কোথাও লুকিয়ে থাকতেন। এভাবে হঠাৎ তাঁরা গাতফান গোত্রে পৌঁছে যান।তারাও ছিল ভীষণ সাহসী। সাথে সাথে বহুলোক উপস্থিত হয়ে গেল এবং যুদ্ধ শুরু হলো।
আবু কাতাদাহ সঙ্গীদের বললেন, যারা তোমাদের সাথে লড়বে শুধু তাদেরকেই হত্যা করবে। সবাইকে ধাওয়া করার কোন প্রয়োজন নেই।
এমন নীতি গ্রহণের ফলে দ্রুত যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। মাত্র ১৫ দিন পর প্রচুর গনিমতের মাল সঙ্গে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।
এ ঘটনার কিছু দিন পর আল্লাহর রাসূল (সা) রমজান মাসে আটজন লোকের একটি দল বাতানে আখামের দিকে পাঠান।
এঁদেরও নেতা ছিলেন আবু কাতাদাহ।
রাসূল (সা) মক্কায় সেনা অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মানুষ যাতে এ কথা মোটেই বুঝতে না পারে এ জন্য এই দলটিকে পাঠান।
মূলত মানুষের চিন্তা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ কাজ করেন।
জি-খাশাব পৌঁছার পর এ দলটি জানতে পেল যে, রাসূল (সা) মক্কার দিকে বেরিয়ে পড়েছেন। সুতরাং তাঁরা সুকাইয়্যা নামক স্থানে রাসূলুল্লাহর (সা) বাহিনীর সাথে মিলিত হন।
মক্কা বিজয়ের পর হুনাইন অভিযান পরিচালিত হয়। এ অভিযানে লড়াই এত তীব্র ছিল যে, মুসলমানদের অনেক বড় বড় বীরও পিছু হঠতে বাধ্য হন।
আবু কাতাদাহ এ যুদ্ধে দারুণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
এক স্থানে একজন মুসলমান ও একজন মুশরিক সৈনিকের মধ্যে হাতাহাতি লড়াই হচ্ছে। দ্বিতীয় একজন পেছন দিক থেকে মুসলিম সৈনিককে আক্রমণের পাঁয়তারা করছে। ব্যাপারটি আবু কাতাদাহর নজরে পড়লো।
তিনি চুপিসারে এগিয়ে গিয়ে পেছন দিক থেকে লোকটির কাঁধে তরবারির ঘা বসিয়ে দিলেন।
লোকটির একটি হাত কেটে পড়ে গেল; কিন্তু অতর্কিতে সে দ্বিতীয় হাতটি দিয়ে আবু কাতাদাহকে চাপ দিল যে, তাঁর প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম হলো।
দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছে, এর মধ্যে লোকটির দেহ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় সে দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই সুযোগে আবু কাতাদাহ লোকটির দেহে আরেকটি ঘা বসিয়ে দেন, লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এরপর মুসলিম বাহিনীর মধ্যে দারুণ ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। তারা ময়দান থেকে যে যেদিকে পারে, পালিয়ে যাচ্ছিল।
আবু কাতাদাহও এক দিকে যাচ্ছেন। পথে এক স্থানে হযরত উমারের (রা) সাথে দেখা। আবু কাতাদাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন : কী ব্যাপার?
উমার (রা) বললেন : আল্লাহর যা ইচ্ছা। এর মধ্যে মুসলমানরা দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং রণক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে।
হযরত আবু কাতাদাহ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সার্বক্ষণিক সাহচর্য ও খিদমতের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।
একবার এক সফরে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সঙ্গী ছিলেন। রাসূল (সা) সাহাবীদের বললেন, পানি কোথায় আছে তা খুঁজে বের কর অন্যথায় সকালে ঘুম থেকে পিপাসিত অবস্থায় উঠতে হবে।
লোকেরা পানির তালাশে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু হযরত আবু কাতাদাহ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সাথেই থেকে গেলেন।
রাসূল (সা) উটের ওপর সওয়ার ছিলেন।
ঘুমকাতর অবস্থায় তিনি যখন এক দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন তখন আবু কাতাদাহ এগিয়ে গিয়ে নিজের হাত দিয়ে সে দিকে ঠেস দিচ্ছিলেন।
একবার তো রাসূল (সা) পড়ে যাবারই উপক্রম হলেন। আবু কাতাদাহ দ্রুত হাত দিয়ে ঠেকালেন। রাসূল (সা) চোখ মেলে জিজ্ঞেস করলেন : কে?
বললেন : আবু কাতাদাহ।
রাসূল (সা) আবার জিজ্ঞেস করলেন, কখন থেকে আমার সাথে আছ?
বললেন : সন্ধ্যা থেকে।
তখন রাসূল (সা) তাঁর জন্য দু’আ করলেন এই বলে : হে আল্লাহ! আপনি আবু কাতাদাহকে হিফাজত করুন যেমন সে সারা রাত আমার হিফাজত করেছে।
একবার হযরত আবু কাতাদাহ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) একটি মু’জিযা প্রত্যক্ষ করেন। আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহর (সা) সঙ্গে ছিলাম। এক সময় যাত্রা বিরতিকালে তিনি জিজ্ঞেস করলেন : আমাদের সাথে কি পানি আছে?
বললাম : হ্যাঁ। আমার কাছে একটি পাত্রে কিছু পানি আছে।
বললেন : নিয়ে এসো।
আমি পানির পাত্রটি নিয়ে এলাম।
তিনি বললেন : এর থেকে কিছু পানি নিয়ে তোমরা সবাই অজু কর।
অজুর পর সেই পাত্রে এক ঢোক মত পানি থাকলো।
রাসূল (সা) বললেন : আবু কাতাদাহ, তুমি এ পানিটুকু হিফাজতে রেখে দাও। খুব শিগগিরই এর একটি খবর হবে।
আস্তে আস্তে দুপুরের প্রচণ্ড গরম শুরু হলো।
রাসূল (সা) সঙ্গীদের সামনে উপস্থিত হলেন। তারা সবাই বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! পিপাসায় তো আমাদের জীবন যায় যায় অবস্থা।
তিনি বললেন : না, তোমরা মরবে না।
এই বলে তিনি আবু কাতাদাহকে ডেকে পানির পাত্রটি নিয়ে আসতে বললেন।
আবু কাতাদাহ বলেন : আমি পাত্রটি নিয়ে এলাম।
রাসূল (সা) বললেন : আমার পিয়ালাটি নিয়ে এসো।
পিয়ালা আনা হলো।
তিনি পাত্র থেকে একটু করে পানি পিয়ালায় ঢেলে মানুষকে পান করাতে লাগলেন।
পানি পানের জন্য রাসূলুল্লাহর (সা) চারপাশে ভিড় জমে গেল।
আবু কাতাদাহ বলেন : একমাত্র রাসূল (সা) ও আমি ছাড়া সকলের পান শেষ হলে তিনি বললেন : আবু কাতাদাহ এবার তুমি পান কর।
আমি বললাম : আপনি আগে পান করুন।
তিনি বললেন : সম্প্রদায়ের যিনি সাকি বা পানি পান করান, তিনি সবার শেষে পান করেন।
অতঃপর আমি পান করলাম এবং সবার শেষে রাসূল (সা) পান করলেন।
সবার পান করার পরও পাত্রে ঠিক যতটুকু পানি ছিল তাই থেকে গেল।
সে দিন তিন শো লোক ছিল। অন্য একটি বর্ণনা মতে, লোক সংখ্যা ছিল সাতশো।
আবু কাতাদাহ! যুবক তো নয়, যেন দরিয়ার এক তুমুল জোয়ার! যে জোয়ারের বেগ এবং তেজ রুখতে পারে না কেউ। তিনি রাসূলকে (সা) যেমন ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে, ঠিক তেমনি ভালোবাসতেন ইসলামকে।
আল্লাহর ভয়ে এই কোমল এবং সাহসী মানুষটি সকল সময় থাকতেন প্রকম্পিত।
আবু কাতাদাহ! তাঁর জীবন থেকে আমরা অনেক কিছুই শিক্ষা নিতে পারি। নেয়াই উচিত। কারণ আমরাও তো চাই আমাদের সফল জীবন!