সাহেবী কথন:
আমার সাহেবের মতন আনকমন ব্যক্তি আমি এই জন্মে দেখি নাই, দেখি নাই মানে দেখিইইই নাই।
আল্লাহর কাছে আনকমন চেয়েছিলাম আল্লাহ ছাপ্পড় ফাড়কে আনকমন মানুষ আমাকে দিয়ে দিয়েছেন।
আমি আরো মাস চারেক আগ থেকে চিল্লাচ্ছি, " চলেন না মাওয়া যাই, সবাই মাওয়া যায় আমিও যাবো মাওয়া।
ইলিশ মাছ খাবো "। এই ঘ্যান ঘ্যানানি করতে করতে, জিদ করে বলাই ছেড়ে দিয়েছিলাম।
আমি এত বার বলেছি, বাট আল্লাহর বান্দা রাজিই হয় নাই মাওয়া যেতে। এক বার বলেছে সময় নাই, আরেকবার বলেছে বাইক নেওয়ার পর, তারপর যাবে।
আমি যতবারই যাওয়ার জন্য চেপে ধরেছি, সে ততবারই বাণ মাছের মতন মুচড়িয়ে বেরিয়ে গেছে, কেমনে কেমনে জানি।
মনের দুঃখে তাই মাওয়া যাওয়ার কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। মনে মনে ফুলন দেবীর মতন প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম যে " আর কমুই না মাওয়া যাওয়ার কথা দেখি কি হয় "।
বুধবার রাতটা গিয়েছে চরম বাজে, সাড়ে বারোটায় আমার সাথে তুমুল ঝগড়া করে এ লোক অফলাইনে। আমাদের ঝগড়ার মজার এক কাহিনী আছে,
আমাদের ঝগড়াটা এক পাক্ষিক হয়। সে চিল্লায় আমি শুনি, আর এই ঝগড়াও হয় বছরে দুই এক বার।
দুই বছরে দুই বার ঝগড়া হয়েছে, প্রতিবারই আমি নাক চোখের পানি এক করেছি। আর এই লোক নিরবতা নামক শাস্তি আমাকে দন্ড স্বরুপ দিয়ে গেছে। যাই হোক না কেন, শাস্তির কাহিনী অন্য কোন একদিন শোনাবো।
বুধবারের ঝগড়া মিটমাট হয়েছিল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে। মুখ ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বসে ছিলাম, আর সে সরি বলেছিল। শুধু তাই না বউ বউ করে মোটামুটি বাড়িও মাথায় করে নিয়েছিলো। শেষমেষ তার খালামনি জিজ্ঞেসই করতে ফেলেছিল, " এই তুই এমন বিড়বিড় করে কি কস রে?"
ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কি। যাইই হোক সব মান অভিমান মিটমাট করার পর, রাতেই তাকে বলেছিলাম,
___ " শোনেন আমি কালকে অফিসে যাবো কাজ আছে আমার, মনে হয় সারাদিন লেগে যাবে।"
___ " তাইলে তুই কখন যাবি বল, আমি এসে তোরে নামায়ে দিয়ে যাবো অফিসে।"
আমার কথা শুনেই সে অফার দিয়ে বসেছিল। আমি জানাবো বলে কথা এড়িয়েছিলাম, উত্তরা থেকে যাত্রাবাড়ি আসবে শুধু আমাকে নামাতে এটাই হজম হচ্ছিল না।
শুক্রবার চরম ব্যস্ত একটা দিন যায় আমাদের বাসায়, আসলে ঘুম থেকে উঠিইই ওই দিন ১১ টার পরে, তার উপরে ভাবিও নাই বাসায়। সকালে সাহেবকে সালাম দিয়েই ভ্যানিশ আমি।
পরে ফোন হাতে নিয়ে দেখি সে শুধু মেসেঞ্জারেই না,, আমার নাম্বারেও মেসেজ দিয়ে বসে আছে। আমি যখন অনলাইনে এলাম সে আবার তখন নাই। দুপুরে যখন গোসল করে আবার নেটে এসেছি মানুষটার খোঁজে তখন দেখি সে আর্জেন্ট কল দিতে বলেছে, কল দিতেই বলল,
___ " এই শোন আমি ওয়ারী এসেছি বিয়ের দাওয়াতে, তুই যাবি পান্থপথ তাহলে তোকে নামিয়ে দিয়ে আসি।"
তার মেসেজ পেয়ে যেন আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এ লোক এই দুপুরে ওয়ারীতে...... আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
___ " আমি আজকে ফ্রি আছি, আপনি আসেন আমি আসতেছি।"
এটুকু বলেই কি করে যে রেডি হয়েছি আল্লাহ মালুম। রেডি হয়ে নিচে নামতেই আবার মেসেজ,
___ " শোন সাইড ব্যাগ নিয়ে বের হইস.....!'
এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন আমার সাইড ব্যাগ নিয়ে এ বেডার এত মাথা ব্যাথা কেন।
উত্তর হলো তার মাথা ব্যাথা এই কারণে, সে তার মানিব্যাগ থেকে শুরু করে গাড়ির কাগজ পর্যন্ত আমার ব্যাগে ঢুকায়। এমনকি তার ফোন....সেটা পর্যন্ত আমার কাছে। যাই হোক যখন বাসা থেকে বের হলাম, তখন রিক্সা না পেয়ে মোটামুটি দৌড় দিয়ে হাজির হলাম সাহেবের সামনে।
মানুষটাকে দেখে আবার মুগ্ধ হলাম, সাদা কালো মিশেলের পাঞ্জাবি আর ডীপ ব্লু জিন্সে যেন আরো অন্য রকম লাগছিল। মাতাল হতে গিয়েও চেপে গেলাম, বাইক ছাড়ার পরেই প্রশ্ন করলো,
___ " আচ্ছা বল কই যাবি?"
এই লোকের এই প্রশ্নটা শুনলে চরম মাত্রার বিরক্তি লাগে আমার। প্রতিদিন এই প্রশ্নটা সে মিনিমাম দশবার করে, আর আমি চোখ মুখ কুঁচকে বলি,
___" আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানে যাবো"।
আমার উত্তর শুনেই বলল,
___"চল ঢাকা ভার্সিটিতে ঘুরি, বসে চা খাবো।"
প্রথমে একটু গাইগুই করে রাজি হয়ে গেলাম।
ঢাকা ভার্সিটিতে এক চক্কর দিয়েই বললাম,
____ " এখানে অনেক ভীড় ভালো লাগছে না চলেন, পোস্তগোলা ব্রিজে যাবো, ওখানের ভিউ সুন্দর। "
বিনা বাক্যব্যয় করেই মানুষটা রাজি হয়ে গেল। ফ্লাই ওভারে উঠতে উঠতে বলল,
___ " এই তোর সময় আছে কত রে, বাসায় যাবি কখন।"
___ " আটটা সাড়ে আটটার মধ্য গেলে চলবে।"
আমি চারপাশ দেখতে দেখতে উত্তর দিলাম৷ যখন পোস্তগোলা ব্রিজ পার হই তখন হঠাৎই সে বলল,
___ '" শোন কেরানীগঞ্জ যাই, যাবি..."!
মনে মনে ভীষন খুশি হয়ে গেলাম, কিন্তু মুখে বিরক্তিভাব ধরে রেখেই বললাম,
___ " চলেন....."
যারা ঢাকা মাওয়া রোডে গিয়েছেন তারাই জানেন এখনকার এই এক্সপ্রেস ওয়ের রাস্তা কতটা সুন্দর। বিশেষ করে ব্রিজের দুই পাশের লাইটিং গুলো জাস্ট অসাম৷ এই রাস্তা দেখলে মনেই হয় না যে আমি বাংলাদেশে আছি। মনে হয় ইউরোপের কোন কান্ট্রির রাস্তা এটা। যাই হোক দুই পাশের এত এত সুন্দর ভিউ দেখতে দেখতে যাচ্ছি যে খুশিতে দাঁত বের হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সাহেব বলে উঠলো,
___ " তুই তো চারপাশ দেখছিস, আমি তো আয়নায়ে শুধু তোকেই......."।
এটুকু শুনেই লজ্জায় লাল নীল বেগুনী হয়ে উঠে তার পিঠে আলতো এক চাপড় মেরে বললাম,
___ " সামনে দেখে গাড়ি চালান।"
আমার সাহেবের সাথে যখনই আমি বাইকে উঠি, দুই পা দুই পাশে দিয়ে বসি, এতে যেমন কমফোর্ট ফিল হয় ঠিক তেমনি তার উষ্ণতা পুরোটুকু আমি অনুভব করতে পারি। তার কাধে নাক ডুবিয়ে তার ঘ্রাণের মাঝে হারাতে পারি। দু হাত দিয়ে তার কোমর বুক আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে পারি। যাই হোক বাইকের গতি আর তার সাথে কথায় কথায় যখন ধলেশ্বরী ব্রিজ পার হলাম তাকে বললাম, " বাইক ঘুরাবেন কোথা থেকে!" সে মুখে মুচকি হাসি নিয়ে বলল,
___ " আর একটু সামনে যাই না, ভালো লাগছে না তোর...?"
এখন সাহেবকে আমি কি করে বুঝাবো যে, আমার মনে তো ফুল ভলিউমে গান বাজতেছে, "এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।" কিছু না বলে তার কাধে নাক ডুবালাম। একটু পরেই হঠাৎই খেয়াল হলো মাওয়া ১২ কি মি। এইটা দেখেই আমি বললাম,
___ " আমরা যাচ্ছি কই।"
___ " মাওয়া চলে এসেছি।"
তার সেই আমাকে এলোমেলো করে দেওয়া হাসিটা উপহার দিয়ে বলে উঠলো। আমি না যখন খুব বেশি খুশি হই তখন খিল খিল করে হাসতে থাকি। যাকে বলে আমার খুশি প্রকাশের উপায় হলো হাসি। আমি যেন খুশিতে হাসতেও ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু ঘাড় বেকিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, আমি........। প্রতিদিন প্লান করেও যেখানে আসা হয় নি, আজ সেখানে হুট করে কোন প্লান ছাড়াই দুম করে চলে আসা, এ যেন এক বর্ণনাতীত মুগ্ধতা। এক রাশ ভালোবাসা ছুঁয়ে দেয় যখনই এই সব সারপ্রাইজ গুলো নিয়ে সে আসে আমার কাছে।
মাওয়া যেয়ে তার হাত ধরে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো, তার সাথে উন্মাদ্দ পদ্মার রুপ দেখা সন্ধ্যার মিষ্টি আলোতে। সে এক অন্যরকম ফিলিংস যা কখনও কাউকে বোঝানো যাবে না, কখনও না। মাওয়াতে বেশ কিছুক্ষন ঘোরার পরে যখন আবার ফিরে আসছিলাম, তখন এক মুগ্ধতার আবেশ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
অনেকেই বলে এসব কেয়ারিং সারপ্রাইজ দেওয়া আদিখ্যেতা, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এসব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সবার ভালোবাসা প্রকাশের মানদন্ড ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আমার সাহেবের ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গি একটু বেশিই ভিন্ন। মাওয়া আমি সব সময় যাই, ইনশাআল্লাহ বেচে থাকলে যাওয়া হবে আরো অনেকবার। কিন্তু আজকের মতন এই অনুভবটা যে আর কখনও আসবে না।
কখনওই না। কেন জানি না মনে হয় সৃষ্টিকর্তা আমার সব অপূর্ণতাকে পূর্ণ করতেই তাকে আমার জীবনে এনে দিয়েছে। সে আমাকে ভালোবাসে প্রতিদিন নতুন নতুন আঙ্গিকে। কখনও আমাকে বলে নি যে সে আমায় ভালোবাসে, কিন্তু তার প্রতিটি কদমে সে বুঝিয়ে যায় তার পুরো পৃথিবীময় শুধুই যে আমার রাজত্ব।
ভালোবাসি আপনাকে, অনেক অনেক।