বড়োছড়ি পাড়াগাড়ি করে নৌকায় উঠছে।
আগে আছে, ভিড় কইরো না, আর উইঠেন নানাও ডুববো কইলাম।
কিন্তু কেউ কারো কথা শোনে না।
।
রাকাটা দুধ্যে ডুবো অবস্থায় ছাড়ল। প্রফেসরের স্ত্রী চশমা চোখে, দু চোখে কালি পড়েছে নির্ঘুম রাতের দুটি কখনো নৌকায় চাপেনি-নৌকার দুলুনিতে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। এক বুড়ি চিৎকার করতে শুর এল রাখাইল্যা রইয়া গেলো, নাও ঘুরাও, বাবারা নাওভারে ঘুরাইতে কও, আমার রাখাইল্যা রইয়া গেলে টির কথা শোনে না কেউ।
ফেসরের বাচ্চা দুটি কাঁদছে ভয় পেয়ে, তাদের কথাও শোনে না কেউ। পায়ের ব্যথাটা ভয়ানক টনটন করছে জান। এতক্ষণ টের পায়নি। এবার পায়ের ওপর হাত বোলাল। হাতের ব্যথার জন্যে চিন্তা নেই। হাতটা কে গনো কাজে লাগছে না। পা-টা টেনে নিয়ে চলতে হবে- এটাই সমস্যা।
পেছনে তাকায় না কেউ। অথচ পেছনে পিলপিল করে মানুষ নেমে আসছে নদীর ঘাটে। কাকুতি মিনতি করছে নৌকার জন্যে। কিছু মাত্র ক খানি তো নৌকা মাঝিদের পয়সা চাইতে হয় না, সওয়ারিরাই দাম হাঁকছে-দশ টাকা দেবো, এদিকে এসো। তবে ঐ হাঁকডাকই সার। কারো কথা শোনার জন্যে কেউ বসে নেই। স্বেচ্ছাসেবক কয়েকজন হয়তারা মার্কা টুপি মাথায় হাঁকছে-কেউ বেশি পয়সা নেবে না। যা রেট তার এক পয়সাও বেশি নয়।
কিছু সম্মিলিত শব্দ আর কোলাহল শুধু। পেছনে তাকায় না কেউ। শুধু অধীর আগ্রহ, নৌকা এখন তীর ছোঁবে। প্রফেসর গিছি কী ভাবছেন যেন। তাঁর হাতে ঘড়ি বালা চুড়ি সব একসাথে শোভা পাচ্ছে। বোধহয় অনিশ্চিত পথের কথা ভেবে ঐ রকম জিনিসপত্র হাতে একসঙ্গে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। প্রফেসরও সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবার ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে নিলেন একবার। দেখছেন সামনে, তীরে অসংখ্য লোক দাঁড়িয়ে। পরিচিত মুখ দেখে কেউ কেউ উদ্বিগ্ন স্বরে স্বজনের খোঁজ করছে। আমার ভাই আনসারকে দেখেননি? ও তো ইসলামপুর খাঁড়ির পেছনের বাড়িটাতে থাকত। আহা নয়াবাজারের কাঠগোলায় মনোহর থাকে, তারে দেহো নাই? কী-হ সব জ্বালাইয়া দিছে, আহারে। হালারা জানোয়ার নাকি। ঢাহা দুইবো না। আল্লায় বিচার করবো-আল্লার মাইর দুনিয়ার বাইন, দেইখোন। শ্যাক সায়েবের খবর জানেন কিছু? ছাত্রগো সবাইরে নাকি মাইরা ফালাইছে?
কত কথা, কত জিজ্ঞাসা, কেউ উত্তর দিতে পারে না। হাসানকে জিজ্ঞেস করে প্রফেসর রায়হান বলেন, কী ভাই, পারবে তুমি?
ছি, পারব। হাসান জবাব দেয়। পায়ের জখম বেশি নয়। হাতটা জখম হয়েছে বেশি-তা হাতের তো কোনো আজ নেই এখন।
নৌকা ভিড়তেই পাড় দিয়ে নামতে শুধু করল সবাই। কারো তর সয় না। রায়হান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
শ্রী কিছু বললেন না, পা নামিয়ে দিলেন পানিতে, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেল কাপড়। নিচের দিকে বুঝি বা কিছুটা
দিবস। একটি বাচাবে ভোলে নিলেন, করেগর উঠে গেলেন শ্রীরে। পেছনে আরেকটি বাচ্চাকে নিয়ে প্রফেসর
কামচান, হাঁটু পর্য্যা পাল্টে দেখা। হাসনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, পরের নৌকায় তিনটি মেয়ে। ওর মধে
কিছু বলেন না। ম্লান হাসি ফোটে দুজনের মুখে।
হাসানেরও হাসি পায়। শটগান কয়েকটা, আর গোটা তিনেক ৩০৩ রাইফেল নিয়ে কয়েকটি ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমগাছ তলায়। কয়েকজনের হাতে শুধুই বাঁশের লাঠি। হাসি পায় শুধু, কোনো মন্তব্য করে না।
ইতিমধ্যে পরের নৌকা দুটিও এসে পৌঁছেছে। নেমে আসছে মানুষ। ঐ দেখো ওপারে একটা নৌকা কাত হয়ে
ভেজা বালি আটকাতে পারে না। অবশ্য আসগার শক্ত হাতে ওদের বরে আছে। রায়হান পেছনে আত একম তাকিয়ে নিলেন।
আহা ছেলেটির বড়ো কষ্ট হচ্ছে বোধহয়। দেখা গেল বাঁ পায়ে ভর দিতে পারছে না। একটি মেয়ের সঙ্গে কাও কথা হলো। বাকি মেয়ে দুটি ততক্ষণে ওপরে উঠে এসেছে।
ওদিকে উত্তরে শহরের আকাশে এখনও ধোঁয়ার কুন্ডলী। আইনে থেকে বাঁয়ে, গোনা যায় আজ একটং, দুঃ তিনটে, চারটে, পাঁচটা ঐ যে আরেকটা, এদিকে বাঁয়ে আবার আরেকটা আরম্ভ হচ্ছে। তবু গোনা বড় গতকাল গোনা যেত না। আহা ছেলেটি পড়ে যাবে না তো।
আসগার এগিয়ে যেতেই ডান হাত বাড়িয়ে হাসান তাকে ধরল। ধরে নিজের পতন সামলে নিল। কোনো এক হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, একটু ধরুন ভাই।
এখানে মানুষকে মানুষ উদার সাহায্য করছে। কিন্তু একটু দূরে নদীর ওপারেই কারো দিকে ফিরে তাকার। অবকাশ নেই কারোর। অন্তত গতকাল ছিল না। এখনো থেকে থেকে রাইফেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে প্রেমে ফাটছে কোথাও কোথাও। ঐ ধোঁয়ার কুন্ডলীগুলোর প্রত্যেকটি জ্বলে ওঠার সময়ে মেশিনগানের গুলি চলেও গ্রেনেড ফেটেছে। গতকাল ঐ কান্ড যে কত হয়েছে, কেউ হিসেব রাখেনি। আজও কি রাখা হচ্ছে? কে জানে।
হাসান বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় উঁচু পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে। এমনিতে ইচ্ছে করছে না হাত-পা নাড়াতে। লালব- থেকে বেরোবার সময়ে তপন আর কায়সার বলে দিয়েছে খবরদার কোথাও থামবি না, দশ-পনেরো মাইন ইন্টিরিয়ারে গিয়ে তবে অন্য কথা। নদীর ওপারেও শালারা হামলা করবে।
হাসান হঠাৎ ভাবল, একটু পানি পেলে হতো। মুখটা তেতো তেতো লাগছে। বোধহয় জ্বরটা আবার আসছেন ডক্টর মজুমদার বলে দিয়েছেন জ্বর আবার আসতে পারে, ব্যথাটাও বাড়বে, তবে থাবড়াবেন না। আর খা ব্যান্ডেজটা ভেজাবেন না, রোজ চারটে করে কম্বায়োটিক নেবেন।
রায়হান পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে কেমন দিশেহারা বোধ করছেন। কিছু বুঝছেন না কী করবেন। রাস্তা অবশ একটাই। কিন্তু রাস্তায় ভিড় বলে মানুষ উপচে পড়ছে মাঠে। বাড়িঘরের ফাঁকে ফাঁকে উজিয়ে চলেছে সবাই। এ গায়ে-গায়ে-লাগা ঠেলাঠেলি ভিড়ের রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু শোনা গিয়েছিল বাস পাওয়া যাবে। এখন শুনল বাসও আর চলছে না।
বিনু তখন প্রায় ভেঙে পড়েন। এক রকম ফুঁপিয়ে ওঠেন হতাশায়। স্বামীর কাছে অনুযোগ জানান- তোমার নি মাথা খারাপ, এভাবে যাওয়া সম্ভব? অসুস্থ ছেলেদের নিয়ে কেমন করে হাঁটব-হেঁটে কোথায় যাব?
তাহলে? রায়হান প্রশ্ন করেন, ফিরে যাবে? ফিরলে চলো, ফিরে যাই।
বিনু কী বলবেন। শুধু ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছে তাঁর। নদীর ওপারে তাকালে বুকের ভেতরকার দল
বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কেমন একটা ভয়ানক কষ্ট হয়। ফেরার কোনো পথ নেই। একটি লোকও ফিরে যাচ্ছে
না, শহরমুখো একটি লোক নেই। শুধু আসছে-ঘরবাড়ি দালানকোঠার ফাঁক-ফোকর দিয়ে গলে গলে পড়লে
মানুষ! পিল পিল করে ছুটে আসছে চারদিক থেকে, নদীর জলসীমায় এসে দাঁড়াচ্ছে নদী দূর দিয়ে বাঁন
নিয়েছে, আর মানুষের একটা স্রোতও যেন অমনি একটা বাঁক নিয়ে রয়েছে।
আসগার একটা লাঠি নিয়ে এল, দেখুন এতে হবে কি না। হাসান লাঠি পেয়ে খুশি, হবে এতেই হবে। জখম ছেলেটির উপকার করতে পেরে আসগার গর্ববোধ করে।
তারপর সে নিজের শিক্ষকের দিকে মনোযোগ দিলো। খোঁজ নিয়ে এসে জানাল, না স্যার, গাড়ির কোনো ব্যবস্থা হবে না। আর অতো ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, আপনি থেকে যান এখানে। এদিকে ভয়ের কিছু নেই-নদী পার হয়ে এদিকে আর্মি আসবে না। সবাই তো এদিকে, ছাত্রনেতারা সবাই এসে আছেন আমাদের পাড়ায়। আর ঐ যে ও-পাড়াটা দেখছেন, ঐ যে তালগাছ কটা-ঐ পাড়ায় ইউনিভার্সিটির প্রফেসররা আছেন। এখানে দুদিন থাকুন, তারপর কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তেমন দেখলে নৌকা ভাড়া করে দেব-নিরাপদ জায়গায় চলে যাবেন। আর অবস্থা খারাপ হলে কে-ই বা এখানে পড়ে থাকবে বলুন?
হাসানের কথা শুনতে পায় না আসগার। হাসান থেকে থেকেই শুধোচ্ছে-এদিকে চায়ের দোকান নেই? চায়ের দোকানটা কোন দিকে ভাই?
বিনু তখন দেখছে এক ভদ্রলোক মস্ত মস্ত দুই সুটকেস নামাচ্ছেন নৌকা থেকে। ওদিকে আরেকটা নৌকা এসে গেল। ভদ্রমহিলার হাতে একটা মুরগি। বোধহয় ঐটিই হাতের কাছে পেয়েছেন বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে।
রায়হান মনস্থির করতে পারেন না। মনে পড়ছে, বাড়ি থেকে বেরোবার মুহূর্তে একটি ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে জানিয়েছিল, যেদিক দিয়েই যান-নদীটা পার হয়ে অন্তত চলে যাবেন-যত দূর পারেন ইন্টিরিয়রে চলে যাবেন আমরা নদীর ওপার থেকে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব।
ভিড় ক্রমশ বাড়ছে পাড়ের ওপর। দাঁড়াবার জায়গাটুকুও থাকছে না। সরতে সরতে রাস্তায় এসে পড়েছে সবাই- এবং সেখানে আরেকটি স্রোত। ঐ অবস্থাতেই একসময় হাঁটতে শুরু করেছেন রায়হান-সেই সঙ্গে বিনু এবা ছেলে দুটি। আসগারও হাঁটছে সঙ্গে সঙ্গে। বোঝাচ্ছে, চলুন ভাবি, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বিশ্রাম নেবেন, কি
মুখে দিয়ে তারপর না হয় রওনা দেবেন।