অনেকদিন পর ব্যাট করতে নামার ফলে একটু টেনশনে ছিলাম, তাও বল করছে আমাদের গ্রামের স্বরূপ প্রথম ব্যাট করে অন্য দল এত রান করেছে, যে তার অর্ধেক করতে পারলেই বুঝব ম্যাচ জিতে গেছি। আমার পাশেই তখন রিতু মানে আমার খুড়তুতো বোন সে আমাকে উৎসাহ যোগানো বোদলে টিপ্পনী দিচ্ছিল। তার বয়স মাত্র 7, ক্রিকেটের সে কিছু বোঝেনা এটুকু জানে যে আমাকে মনঃসংযোগ করতে না দিলে, আমাকে ব্যাট ছেড়ে দিতে হবে। এটা পড়ে ভেবে বসবেন না যে কোন বড় টুর্নামেন্ট খেলছি এমনকি এটা তো গ্রামের একটা ছোট টুর্নামেন্টও নয় আর খেলছি কোন বড় বা ছোট মাঠে ও নয় খেলছি আমার জেঠাবাবুর বাড়ির উঠোনে আর দর্শক সংখ্যা এক মানে আমার বোন রিতু। যাইহোক স্বরূপ বলটা করলো, আমি চোখ বন্ধ করে দিলাম ব্যাট চালিয়ে তাকিয়ে দেখি বল 4 হয়েছে কিন্তু পড়েছে জেঠাবাবুর প্রিয় বাগানে আর যেখানটায় পড়েছে সেখানটায় লতাপাতার জঙ্গল আর আছে এক কুমড়ো গাছ। সবাই গেলাম বল খুঁজতে কিন্তু ওই বনের মধ্যে এই সরি সুন্দর বাগানে বলটা খুঁজে পাওয়া অতি দুস্কর ব্যাপার। আমাদের ক্যাপ্টেন রিন্টু দা বলল, মঙ্গল দা ব্যাট দিয়ে একটু চারদিকটা চটিয়ে দেখব কিন্তু কুমড়ো গাছের ক্ষতি হতে পারে। মঙ্গল দা আমার একমাত্র জেঠুর ছেলে, সে, বললো নিশ্চয়ই দেখবি কেন দেখবি না এটা শুনে রিন্টু দা যেই পা বাড়িয়েছে, মঙ্গল দা বলল কিন্তু একটি পাতা ভাঙলে 50 টাকা জরিমানা নেব কিন্তু। তা শুনে রিন্টু দা নিরস্ত্র হলো।
সেই দিনের মত খেলা শেষ যে যার বাড়ির দিকে রওনা হলাম যাওয়ার আগে স্বরূপ বলল খেলাটা হলে কিন্তু জিততে পারতিস না, আমি কোন উত্তর করলাম না কারণ সেটা আমি ভালোমতোই জানি, সাধারণত আমার খুব বেশি খেলাধুলা হয় না এই মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি আসি তখনই খেলা হয়। আমি কিছু দূরেই সদর শহরে থাকি মা বাবার সাথে আর এখানে থাকেন আমার কাকু ও জেঠুর পরিবার সাধারণত গ্রামের বাড়ি এলে আমি কাকুর কাছেই থাকি এইবার এসেছি কালীপুজোর জন্য, গ্রামের বাড়ি কম আসলেও অনেক বন্ধু আছে আর আছে এই গ্রামের সাথে এক অদ্ভুত নাড়ির টান তবে আসল গল্প এটা নয় তা ঘটে সেদিন রাত্রে।
ঋতু আর আমি সন্ধ্যাবেলা গ্রামের এক কালী মন্দিরে যাই কালীপুজোর দিন প্রতিবছর প্রদীপ দিয়ে গোটা মন্দিরটা সাজানো হয়, বেশ সুন্দর লাগে দেখতে, বড় একটা আলপনার মত প্রদীপ রেখে তেল আর সলতে দিয়ে তৈরি করে ছোটরা মোমবাতি হাতে সলতে তে আগুন দেয় আর বড়রা সেটা সাজিয়ে দেয়। বেশ মজা হয় প্রদীপ নিভে গেলেই সবাই মিলে জ্বালানোর জন্য ছুটে যায়। আমার বোন ওদের সাথে কাজ করছে আমি বড়দের সাথে গল্প করছি এমন সময় কিছু দূরে একটা গোলমাল দেখে আমরা বড়রা গেলাম, দেখতে আর ছোটদের বলা হল প্রদীপ গুলো না নিভে যায় সেই দিকে খেয়াল রেখো। ওরা দায়িত্ব পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে আরও ব্যস্ত হয়ে গেল। সেখানে গিয়ে সব শুনে যা বুঝলাম তা খুবই দুঃখের, যে বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেই বাড়িতে একটি বাচ্চা ছেলের হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হয়, তার মা স্বামীকে জানালে তিনি গাড়ির ব্যবস্থা করার আগেই ছেলেটি মারা যায়। সদর ছাড়া ভালো ডাক্তার নেই, গ্রামের ডাক্তার দেখে বলেন সদরে নিয়ে যাও আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয় গ্রামে একটিই গাড়ি সেটা আবার গেছল অন্য গ্রামে। ফিরে আসার আগেই ছেলেটি মারা যায়। মনটা খারাপ হলো আরো বেশি, যখন জানলাম বাচ্চা ছেলেটার দিদি আছে সেও ছোট, মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে, বাচ্চাটার মা বাবা কাঁদছে গরিব পরিবার ছেলেটার বাবা নিজে দিনমজুরের কাজ করেন। যাইহোক বাচ্চাটার দিদিটা, এল খুব কাঁদল সে বলল ভাই উঠ, কাল ভাইফোঁটা তোর জন্য নতুন জামা খেলনা কিনেছি। আর থাকতে পারলাম না, দূরে সরে গেলাম ঋতুকে নিয়ে। বাড়ি ফিরে সেদিনের মত কেটে গেল সময়টা। রাত্রে খেতে বসে কাকুর কাছে শুনলাম চার বছরের বাচ্চা তাই জঙ্গলের কোথায় নাকি পুঁতে দিয়ে এসেছে। পাঁচ বছর না হলে আবার নিয়ম নেই পোড়ানোর আর শ্মশানে পুঁতলে মানুষ ভয় পেতে পারে। সেদিন রাত্রে বাচ্চাটার দিদির কথা গুলো বার বার মনে আসছিল,
এর পর তিন-চার দিন কেটে গেল পাড়ার মোড় গুলোতে ঘটনাটা নিয়ে অনেক আলোচনা হল। আমার এবার বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছিল যেদিন ফিরব তার আগের দিন বিকেলবেলা বাড়িতে খাবার জল শেষ হয়ে গেল। আমাদের গ্রামের কলের জল ভালো নয় তাই খাবার জল আনতে হয় পাশের গ্রাম থেকে। এমনিতে কাকু আনে কিন্তু আমি আসার পর থেকে আমিই এনে দিচ্ছিলাম। ভালো লাগতো কাজ করতে আর ভালো লাগতো সাইকেলে চেপে দু সারি গাছের মাঝে মাটির রাস্তা দিয়ে পাশের গ্রামে যেতে। এই অনুভূতি গুলো খুব সুন্দর, শহরের কোলাহল থেকে দূরে এই প্রশান্তি প্রাণ ভরিয়ে দেয়। সেই জন্য সুযোগ পেলে আমি গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। জল নেবার জায়গায় পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য ডুবলো। এমনিতে এই কলের জল অনেকেই নেয়, ভিড় থাকে কিন্তু এই সময়টা কেউ নেই। একা দুটো বড় পাত্র নিয়ে গিয়েছিলাম জল আনতে, একা একা ভরছি। একা এসেছি কারণ কাকু এখনো অফিস থেকে ফেরেনি আর বোন খেলতে গেছল। জল ভরে সেগুলো সাইকেলে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে এগোতে লাগলাম। সাইকেলের সামনে লাইট থাকায় পথ দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল এমনিতেই জঙ্গলে বাঘ ভালুক থাকেনা শিয়াল আর খরগোশ তিনটি অনেক আছে। মাঝে মাঝে হাতি এসে পড়ে কিন্তু এখন তাদের আসার সময় নয়। হঠাৎ রাস্তায় একটা কিছু দূর থেকে হালকা আলোতে দেখতে পেলাম, ভাবলাম শেয়াল, সামনে আসতে বুঝলাম একটা বাচ্চা ছেলে। গ্রাম দূরে না হলেও খুব কাছে নয়। ভাবলাম কারো সাথে এসেছে, তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি একা এখানে কি করছো? সে বলল মায়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় তোমার মা? সে বলল, বাড়িতে। তুমি আমার মাকে বলে দিয়ো দুঃখ না করতে আমি তাড়াতাড়ি ফিরব। আমি বললাম, কোন গ্রামে বাড়ি তোমার চলো পৌঁছে দিচ্ছি সে ছুটে জঙ্গলে হারিয়ে গেল। মাথা মুন্ডু কিছু বুঝতে না পেরে আমি নিজের গ্রামের রাস্তা ধরলাম। ভাবলাম কোন মানুষের বদ মতলব থাকতে পারে বাচ্চাটার পেছনে গেলে হয়তো আমাকেই না চোরের পাল্লায় পড়তে হয়। কিন্তু সাথে কিছুই ছিল না, তাও কে ডেকে এনে বিপদ বাড়াতে চায়। পরদিন আমি মা বাবার কাছে ফিরে গেলাম।
এরপর আমি কলেজের পড়ার জন্য কলকাতায় ভর্তি হয়ে সেখানে চলে গেছিলাম। বাবা মায়ের সাথেই দেখা হয় না। পড়ার চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়নি। তিন বছর পর শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরলাম কয়েকদিন থেকে গ্রামের বাড়ি যাবো যাবো ভাবছিলাম। একদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম, সেখানে পৌঁছে কাকু জেঠু সবার সাথে দেখা হল। বিকেলে গ্রামে ঘুরতে বের হলাম অনেকদিন পর সবার সাথে দেখা হলো, অনেক গল্প হল। আগের বারের সেই ক্রিকেট খেলার গল্প হতে হতে হঠাৎ মনে পড়ল সেই সন্ধ্যায় বাচ্চাটা মারা যাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। ওদের বাড়ির সবাই কেমন আছে? ওরা বলল, ছেলেটা মারা যাবার পরের বছর ওদের বাড়িতে আরো একটা ছেলে জন্মেছে, অবাক কান্ড জানিস সেই ছেলেটা হুবহু ওর মৃত দাদার মতই দেখতে। কথাটা সোনার পর আমার কানে সেই দিন রাত্রে রাস্তায় দেখা বাচ্চাটার কথা ভেসে উঠলো " তুমি মাকে বলে দিও... আমি তাড়াতাড়ি ফিরব "
নিজের চেম্বারে এতক্ষণ বিমর্ষ হয়ে বসেছিলেন ডক্টর সেন, ওরফে ডক্টর হিমাদ্রী সেন। কলকাতার নামকরা একজন সার্জেন তিনি। আজ বিকালের পর থেকে একটার পর একটা অপারেশন করে গেছেন। সবকটাই সফল শুধু শেষের অপারেশনটা ছাড়া। অপারেশন টেবিলেই মারা গেছেন পেশেন্ট, যে কিনা তাঁর খুব কাছের বন্ধু কিঞ্জলের স্ত্রী। সেই কারণেই আরো বেশী ভেঙে পড়েছেন ডক্টর সেন।
এমনসময় ডক্টর সেনের চেম্বারের দরজায় একটা টোকা পরলো।
-- কাম ইন
চেম্বারের দরজা খুলে একজন নার্স প্রবেশ করলেন ভিতরে। চেম্বারের ভিতরে আসার পর ডক্টর সেনকে উদ্দেশ্য করে সে প্রশ্ন করলো,
-- স্যার বাড়ি যাবেন না? অনেক রাত হয়েগেছে।
-- হ্যাঁ, এই যাবো। মনটা আজ ভালো নেই। কি থেকে কি হয়ে গেলো। বন্ধুর কাছে কি করে মুখ দেখাই।
কথাটা বলেই চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন ডক্টর সেন। নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে চেম্বার থেকে বাইরে বেরোতেই তিনি দেখলেন ডক্টর রায় এগিয়ে আসছেন তাঁর চেম্বারের দিকে। ডক্টর রায় তাঁর থেকে বয়সে অনেক বড়। ডক্টর সেনকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন,
-- তুমি বাড়ি যাও, এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি।
-- কিন্তু আমি যে!
-- ডক্টর সেন তুমি এক নামকরা সার্জেন, এই ভাবে ভেঙে পড়া তোমাকে মানায় না। পেশেন্ট এর অবস্থা এমনিতেও ভালো ছিলো না। বললাম তো তুমি যাও, আমি সামলে নেবো।
ডক্টর সেন আর কথা বাড়ালেন না, আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন লিফটের দিকে। লিফটে উঠে "G" বাটনটা চাপ দেওয়ার সাথে সাথেই ডক্টর সেনের মুখের ভাব পাল্টে গেলো। বিমর্ষ ভাবটা কেটে গিয়ে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো তাঁর মুখের কোনায়। নিজেই নিজেকে বাহবা দিলেন এতোক্ষণ এতো সুন্দর অভিনয় চালিয়ে যাবার জন্য। আসলে এতোদিন ধরে এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলো সে আর তাঁর বন্ধু কিঞ্জল। অনেকদিন থেকেই ডক্টর সেন আর কিঞ্জল অঙ্গ পাচার চক্রের সাথে জড়িত ছিলো। পিয়ালী যে দিন প্রথম জানতে পেরেছিলো সেটা, সেদিনই তাঁরা ঠিক করে ফেলেছিলো ওকে শেষ করে দেবে। তাঁরা দুজনেই চেয়েছিলো কাজটা এমনভাবে করতে, যাতে কেউ সন্দেহ না করে তাদের। তাই এরপর কয়েকদিন টানা পিয়ালীর সামনে অভিনয় করে গেছিলো কিঞ্জল, কাজেই চট করে কিঞ্জলকে বিশ্বাসও করে ফেলে পিয়ালী। কিন্তু তারপর থেকে এতোদিন ধরে পিয়ালীর শরীরে একটু একটু করে বিষ প্রয়োগ করে গেছে কিঞ্জল। কখনো খাবারের সাথে, কখনো জলের সাথে মিশিয়ে দিতো সেই বিষ। আস্তে আস্তে পিয়ালী অসুস্থ হতে শুরু করে, ব্যাস তারপর বাকি কাজটা শেষ করলো ডক্টর সেন। কেউ সন্দেহ করবে না ওদের, পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য ডক্টর সেনের ডাক্তারি বিদ্যাই যথেষ্ট। কথাগুলো চিন্তা করেই একটা শয়তানের হাসি হেঁসে উঠলো ডক্টর সেন।
ঠিক এমন সময় একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলো লিফটটা। লিফটের ভিতরে জ্বলতে থাকা আলোটাও দপ দপ করতে করতে নিভে গেলো। ডক্টর সেন চিৎকার করে উঠলেন,
-- হেল্প! সিকিউরিটি হেল্প।
ডক্টর সেনের চিৎকার সেই বদ্ধ লিফটের ভিতরেই বদ্ধ হয়ে রইলো। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতেই চমকে উঠলো ডক্টর সেন। এ কাকে দেখছে সে? এতো পিয়ালী, ঠিক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। অপারেশনের সময়ে যে পোশাক পরানো হয়েছিল পিয়ালীকে, সেই পোশাক পরেই দাঁড়িয়ে আছে সে। তাঁর চোখগুলোতে ভয়ঙ্কর এক প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। ডক্টর সেন ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। লিফটের এক কোনায় গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন,
-- এ হতে পারেনা, কিছুতেই হতে পারেনা। আ.. আ.. আমি নিজের হাতে....
কথা শেষ করতে পারলো না ডক্টর সেন, তার আগেই পিয়ালী চেপে ধরেছে তাঁর গলা। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ছটফট করছে ডক্টর সেন, তাও পিয়ালী ছাড়ছে না তাঁকে, পিয়ালীর হাত দুটো ক্রমশ আরো শক্ত হয়ে চেপে বসছে তাঁর গলায়।
আস্তে আস্তে ছটফটানি থেমে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ডক্টর সেনের নিথর শরীরটা। আর মিলিয়ে গেলো পিয়ালীর আত্মা। ঠিক সেই সময়েই আবার লিফটটা চলতে শুরু করলো, আর সাথে সাথেই লিফটের আলোটা দপ করে জ্বলে উঠলো।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফট এসে দাড়ানোর সাথে সাথে লিফটের দরজাটা খুলে গেলো, আর ঠিক তখনই সকলে দেখলো, লিফটের মেঝেতে পরে আছেন ডক্টর সেন, বলা ভালো ডক্টর সেনের বিকৃত মৃতদেহ। ডক্টর সেনের মুখটা হাঁ করা, আর চোখগুলো বিস্ফারিত হয়ে আছে লিফটের ছাদের দিকে।
পাওয়ার কাট হয়ে যাওয়াতে সিসিটিভি কাজ করেনি, আর যেহেতু লিফটে তখন ডক্টর সেন ছাড়া আর কেউ ছিলো না, তাই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আর জানতে পারা গেলো না। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা যায়, দম বন্ধ হয়েই ডক্টর সেনের মৃত্যু হয়েছে।
এই ঘটনার ঠিক দু'দিন পর কিঞ্জলের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় কিঞ্জলের ঝুলন্ত মৃতদেহ। সকলেই বলাবলি করেছিলো বউ আর বন্ধুর মৃত্যুতে পাগল হয়ে গিয়ে ছেলেটা আত্মহত্যা করে বসলো। কিন্তু এর পেছনের আসল সত্যিটা আজও সবার কাছে রহস্য।
গৌরীপুর মোড়ে বাস থেকে নেমে ভীষণ অবাক আর হতভম্ব হয়ে পড়লাম, দেখি সকল দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে, তার উপর কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে বাজে। ট্রেন মিস, তার উপর ঠেলাঠেলি-গুঁতোগুতি এড়ানোর জন্য দুটো বাস ছেড়ে দিয়েছি ঠিকই, তবে এতটা যে রাত হয়ে যাবে তা ভাবতেই পারিনি। হয়তো অতটা অবাক হতে হতো না যদি দীর্ঘ এ পথটা বাসের মধ্যে আরামে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে না কাটাতাম।
তা যাই হোক, গৌরীপুর মোড় থেকে মিনিট তিরিশেক সাইকেল জারনি করলেই তিন চারটে ছোট গ্রাম ও একটা বিরাট নির্জন ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে আমার গাঁয়ের দেখা মেলে। গৌরীপুর মোড় থেকে ডানহাতি রাস্তাটায় হনহনিয়ে ঢুকে পড়লাম আমি, ইঁট বিছানো এই পথটাই সীতাগঞ্জ-এর সামনে দুটি শাখায় ভাগ হয়ে গেছে, আর তারই একটা ছুটে গেছে আমার গাঁয়ের দিকে। ডানহাতি রাস্তাটা ধরে কিছুটা হাঁটার পর বাঁপাশে এক ছোট্ট বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম, লোহার টিনবাঁধা সে দরজা, দরজার ওপরের দেওয়ালে বাংলায় মোটা মোটা অক্ষরে লেখা, -" সাইকেল জমা রাখা হয়"। এটা বুড়ো পরেশ সেন-এর বাড়ী, যারা কাজ-কর্ম, লেখা-পড়া ইত্যাদির তাগিদে গাঁ ছেড়ে শহরের দিকে যায়, তারা প্রায় সকলেই এখানে তাদের সাইকেল আর মোটর-সাইকেলগুলো জমা রেখে যায়৷ ভাড়া খুবই কম, সাইকেল প্রতি পাঁচ টাকা আর মোটর সাইকেল দশ টাকা।
বাড়ির টিনের দরজায় কয়েকবার সজোরে আঙুলের টোকা দিলাম কিন্তু কোনো সাড়া মিললো না। শীতের ঠান্ডা হাওয়া দাঁতে দাঁতে কাঁপুনি ধরাচ্ছিলো, মাথার মাফলারটা তাই আরও শক্ত ও কায়দা করে বেঁধে নিলাম। হাতের তালুদুটো ঘষতে ঘষতে ডাক দিলাম, - "কাকু.... দরজাটা খুলুন, সাইকেলটা নেব"। তারপর আরও কয়েকবার আঙুলের টোকা দিলাম, তাও কোনো কাজ হলো না। খুড়তুতো এক দাদাকে ফোন করার জন্য পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখি বেচারি খিদে পেটে কেঁদে কেঁদে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। এক বিরক্তিসূচক শব্দ করে দরজার দিকে ফিরে দাঁড়ালাম, দেখলাম ওপারে একটা কুঁজো কালো মূর্তি অন্ধকার ঠেলে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছুটা সামনে আসতেই লোকটার হাতের হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় তাকে স্পষ্ট চিনতে পারলাম, হ্যাঁ..দোকানী পরেশ সেন। এতক্ষনে আশ্বস্ত হলাম, মনের অনেক দুশ্চিন্তা দূর হলো, মাথাটাও খানিক হালকা হলো।
বুড়ো পরেশ সেন হ্যারিকেনটা উঁচিয়ে ধরে আমার মুখখানা ভালো করে কয়েকবার দেখে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো, - "ও, তুমি ! তা এতো রাত অবধি কোথায় থাকো বাপু? " আমি তেমন কিছু না বলে শুধু একটু হ্যাঁ হুঁ দিয়ে তার পিছু পিছু ঘরে এসে ঢুকলাম, বুড়োর সারা শরীর কালো মোটা আরামদায়ক চাদরে ঢাকা, মাথায় মাঙ্কি টুপি, পায়ে একজোড়া ছাল ওঠা কালো বুট আর চোখে সেই চেনা মোটা ফ্রেমের চশমাটা। কয়েক সেকেন্ড বাদে টর্চ হাতে দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে সাইকেলে চড়ে বসলাম; আর তক্ষনাৎ বাড়ির মোটা লোহার দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমি সাইকেল চালাতে থাকলাম, ইতিমধ্যেই হাতে দস্তানাজোড়া গলিয়ে নিয়েছি। হঠাৎই খেয়াল করলাম কাঁপা কাঁপা ঠোঁটদুটো আমার অজান্তেই কখন গুনগুনিয়ে সুর ভাঁজতে শুরু করে দিয়েছে। শিশুকালে পড়া সেই লাইনটাও মনে মনে আওড়ে উঠলাম, - "উহঃ আহঃ কেন করো/ শীত লাগে তো গানটি ধরো", এভাবেই গুনগুন করতে করতে চললো আমার অভিযান। তা প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট সেভাবেই যাওয়ার পর হঠাৎ যেন আবহাওয়ার হালকা পরিবর্তন অনুভব করলাম, ঠান্ডাটা বোধ হয় এবার একটু বেশিই হুল ফোটাচ্ছে। দেখলাম অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িঘর আর গাছপালাগুলো কেমন যেন রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিয়ে, তারা যেন আমাকে ঘিরে চুপিসারে কিসব ফন্দি এঁটে চলেছে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা কিছু একটা যেন নীচের দিকে অনবরত নেমে যেতে থাকলো, সাইকেলের প্যাডেলে আমি জোরে চাপ দিলাম, কিন্তু সাইকেলটা আগের মতো আর টানতে পারলাম না, পা দুটো যেন ঠান্ডায় জমে গেছে। মনে হলো সাইকেলের পেছনে কেউ যেন হিমালয় পর্বতটাকে বেঁধে দিয়ে গেছে, আর আমি কেতরে কেতরে সেটাকে টেনে নিয়ে চলেছি। ভয়ে শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম, আরো একবার সাইকেলের গতি বাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম, আর ঠিক তখনই আমার ঠান্ডা দেহের বাম কাঁধে এক হিমশীতল হাতের থাবা এঁটে বসলো। সাথে সাথে আমি বীভৎস এক চিৎকার করে সাইকেল থেকে গড়িয়ে পড়লাম, কাঁধের সেই জায়গাটা এখনো ঠান্ডা হয়ে রয়েছে, তবে থাবাটা যেন সরে গেছে মনে হলো। কয়েক সেকেন্ড বাদে আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম, ঘোর মাতালের মতো পাদুটো কেঁপে চলেছে আর গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। দু-তিনবার ঢোঁক গিলে টিমটিমে টর্চের আলোয় চারপাশটাকে দেখলাম, তারপর ভয়ার্ত কাঁদো কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, - "কে তুমি? কি চাও? ", গলার আওয়াজ তো দূরের কথা, ছোটখাটো কোনো শব্দও কানে এসে পৌঁচ্ছালো না। আমি সাইকেলেটা দুহাতে চেপে ধরে আবারও একবার চিৎকার করলাম, - " কে তুমি, কি চাও আমার কাছে? " কয়েক সেকেন্ড কোনো সাড়া নেই, তারপর হঠাৎই একসময় অমাবস্যার ঘন কালো অন্ধকার ফুঁড়ে ঠিক আমার কানের সামনে অশরীরীটা মৃদু-ফাঁপা আর ভয়ানক ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে উঠলো, - "আমি কে, কি হবে তা জেনে? সাইকেলটা চালাও, দ্রুত চালাও, তোমার কোনো ক্ষতি করবো না, অন্যথায়...হে হে হে....তুমি শেষ"। শব্দের সাথে বেরোনো তার মুখের ঠান্ডা বাতাস আমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল, আর বীভৎস এক দুর্গন্ধে সারা গা গুলিয়ে উঠলো।
আমি মুখ বুজে প্রথমে সাইকেলে চড়ে বসলাম, তারপর প্যাডেল করতে আরম্ভ করলাম। এবারেও সেই একই কান্ড, সাইকেল টানতে গিয়েও টানতে পারলাম না, কোনো রকম গড়িয়ে চললো যা। হঠাৎই আমার বাম কাঁধে ঠিক সেই জায়গায় আর পেটের ডানদিকে আবারও তীব্র ঠান্ডা থাবার উপস্থিতি অনুভব করলাম, অশরীরীটা আমাকে দুহাতে চেপে ধরেছে। দেহের ওই দুই স্থানের মাংসপেশি যেন জমে বরফ হয়ে গেলো, এবার দেখলাম সাইকেলটা সজোরে ছুটছে। বুঝতে পারলাম না কোনদিকে ছুটে চলেছি আমরা, সাইকেলটা থামানোর জন্য সজোরে ব্রেক কষলাম তবুও থামাতে পারলাম না৷গাছপালা-ঘরবাড়ি ফুঁড়ে সাইকেল এগিয়ে যেতে থাকলো। একসময় সাইকেলটা তিনমাথা রাস্তার মোড়ে এসে পড়লো, চিনতে পারলাম আমি সেই রাস্তা, এটাই তো সীতাগঞ্জ মোড়। মোড়ের বামহাতি রাস্তাটায় নামলেই আর দশ-পনেরো মিনিটের পথ, প্রথমে পড়বে সেই ফাঁকা মাঠ, তারপরই আমার গ্রাম।
মনে পড়লো মাঠের মাঝখানের ভৌতিক শ্মশানটার কথা, কতো না আজব, কতো না ভয়ঙ্কর সব কান্ড ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি তাকে ঘিরে। গাঁয়ের লোকেদের বলতে শুনেছি ওই শ্মশানে গভীর অমাবস্যার রাতে নাকি সারারাত জুড়ে চলে ভুতেদের তান্ডব, তারা পথিককে ভুলপথে চালিত করে মজা দেখে আর তাদের থলির ভেতর থাকা খাবার-দাবার, ফল-মূল সবই আত্মসাৎ করে ফেলে। ঘন্টা খানেক আগে অবধি আমি এসকল রটনাগুলোকে এতটুকুও পাত্তা দিইনি, কিন্তু আজ এই গভীর অমাবস্যার রাতে দাঁড়িয়ে এক বীভৎস নতুন অভিজ্ঞতার শিকার হলাম। ঘটনা-রটনা আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝের সুদৃঢ় প্রাচীরটা যেন নিমেষেই এক উন্মত্ত সাগরের ঢেউ-এ বরফের মতো গলে গেল।
অবশেষে এসে পৌঁচ্ছালাম শ্মশানের রাস্তাটায়, বহুদিনের চেনা পথটা আজ যেন অচেনা ঠেকছে। কিছুক্ষন আগে অবধি চারিদিকটা ছিল ঘন অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু এপথে পৌঁছে দেখি কোথা থেকে মৃদু মৃদু সব আলো পড়েছে বড়ো বড়ো বট-অশ্বত্থ-শ্যাওড়া গাছের চূড়াগুলোতে, কি বীভৎস গা ছমছমে সে আবহাওয়া; কোনো একদল অশরীরী অতিথির অপেক্ষায় শ্মশানটা যেন সেজেগুজে বসে রয়েছে। সাইকেলের কেরিয়ার জুড়ে বিরাজমান অশরীরীটা তখন আর অতটা ভীতির সঞ্চার করছিল না, তার ঠান্ডা হাতের থাবাটাকেও আমার দেহ মানিয়ে উঠেছিল; মনে মনে ভাবলাম, একবার এই মাঠ পেরোতে পারলে বাঁচি। পেছনের অশরীরীটা কোথায় চলেছে?, আমার সাথে সাথেই বাড়ি অবধি যাবে নাকি কে জানে!এইসকল ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই এক জোরালো ঠেলা খেয়ে আমি সাইকেল থেকে ছিটকে রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে পড়লাম শ্মশানের উল্টো দিকের নিচু মাঠে।
মাঠের মাঝে চিৎ হয়ে পড়েই দেখলাম রাস্তার পাশে ঝুলে থাকা বটের ডালটা ধরে কেউ যেন হুড়মুড় করে গাছে চড়ে বসলো, এতক্ষন সঙ্গে সঙ্গে আসা অশরীরীটাই হবে বোধ হয়। তারপরই হঠাৎ শ্মশানের সমস্ত গাছ-পালাজুড়ে এক জোরালো আলোড়ন শুরু হলো, সাথে বিকট সব চিৎকার। সহস্র অশরীরীর দাপাদাপিতেই বোধ হয় গাছের ডালগুলো হুড়মুড় করে একসাথে ভেঙে পড়লো, মাঠ-ঘাট সব কাঁপতে শুরু করলো আর ঘাস বিছানো সমতল মাঠটা অজস্র ফাটলে ভরে গেল। পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্য ছিলোনা আমার, তবু বহু কষ্টে কোনোরকম উঠে কাতরাতে কাতরাতে বাড়ি ফিরলাম। মুখ, হাত-পা'টা ভালো করে ধুয়ে নরম বিছানায় শরীরটাকে টানটান করে মিলে দিলাম, সারা দেহে অসহ্য ব্যাথা, থার্মোমিটারে দেহের তাপমাত্রা ধরা পড়লো ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। পরদিন সকালে ঘুম