নারী

নারী

পঞ্চম বর্ষে দিনরাত্তির একটি জিনিসই করতে হয়, সেটি লেখাপড়া। সেটি থেকে আমারও নিস্তার পাওয়া হয়

নারী

 

পঞ্চম বর্ষে দিনরাত্তির একটি জিনিসই করতে হয়, সেটি লেখাপড়া। সেটি থেকে আমারও নিস্তার পাওয়া হয় না। হাসপাতালে দিনে তো আছেই, রাতেও ক্লাস থাকে। অধ্যাপক দিনে পড়ান, রাতে পড়ান। কেবল অধ্যাপকই নন, ওপরের ক্লাসে যারা সবে ডাক্তার হয়েছেন, তাঁরাও পড়াতে ্‌ আসেন। রাজিব আহমেদও পড়াতে আসেন মেডিসিন বিভাগে। রাজিব আহমেদ এবারও প্রথম হয়েছেন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যত চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় আছে, সবগুলোর মধ্যে শেষ বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম। ধন্দে পড়ি, এত জ্ঞান তিনি তাঁর ছোট্ট মাথাটিতে ধারণ করেন কি করে! আমার টেবিল জুড়ে রাজিবের সার্জারি মেডিসিন গাইনির খাতা। ছাপলে সাহেবদের লেখা বইএর চেয়ে ভাল বই হবে, আমার বিশ্বাস। রাজিবের করুণাধন্যা আমি, অকাতরে যা আমাকেই দিয়েছেন তাঁর রত্নরাজি। অথচ এই আমার দিকেও বড় একটা চোখ তুলে তাকান না তিনি। ডাক্তারি বিদ্যা ছাড়া অন্য কিছুতে তার কোনও ঝোঁক আছে বলে মনে হয় না। তিনি রোগীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রোগ এবং রোগ নির্ণয় এবং রোগের চিকিৎসায় দীক্ষা দিয়ে যান। রাত্তিরে ক্লাস শেষে আমাকে ফিরতে হয় বাড়িতে। একা ফিরতে ভয় হয়। অন্ধকারকে ভীষণ ভয় আমার। প্রায়ই ক্লাসের বন্ধুদের অনুরোধ করি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে। যেদিন অমন কেউ থাকে না যাকে বলা যায়, তখন শহরে বাড়ি যে ছেলের, যে ছেলে শহরের দিকে যাচ্ছে, তাকে বলি আমার রিক্সার পেছনে যেন তার রিক্সা যায়, বাড়ি অবদি না গেলেও অন্ধকার পথটুকু অন্তত। অন্ধকারের কি শেষ আছে! পেছনের রিক্সা আমাকে অনেকটা পার করে দিলেও থোকা থোকা কিছু কালো একা পার হয়ে যাওয়ার জন্য রয়ে যায়। বিদ্যাময়ী ইশকুলের সামনে ডান দিকের যে গলিতে আমাকে ঢুকতে হয় বাড়ির পথে, অন্ধকার ভুতের মত পড়ে থাকে ও গলিতে—বুক ঢিপঢিপ করে, রিক্সাঅলাকে জোরে চালাতে বলি, যেন এই পথটি দ্রুত পার হয়—মনে হতে থাকে এই বুঝি এক পাল ছেলে আমাকে রিক্সা থেকে নামিয়ে কাছের কোনো ঝোপের আড়ালে নিয়ে ধষর্ণ করবে, ধর্ষণের পর বুকে ছুরি বসাবে, রিক্সাঅলাটিই হয়ত অন্ধকারে রিক্সা থামিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে চলে যাবে কোথাও। দিনে যে কিছু ঘটে না তা নয়, এতকাল যা ঘটেছে, ঘটেছে দিনে। রিক্সায় বসা আমার দিকে কেউ শখ করে থুতু ছুঁড়ে দিল, পানের পিক ছুঁড়ে দিল, হা হা হাসল, খু খু কাশল। ঢিল ছুঁড়ল, ঢিল গেল কানের পাশ দিয়ে, ঢিল লাগল বুকে, মাথায়, হা হা হাসল, খু খু কাশল, দাঁত বেরোলো বত্রিশটি, খুশির দাঁত। রিক্সায় বসা আমার বাহুতে জ্বলন্ত সিগারেট নিবিয়ে মজা করল কেউ, কেউ ওড়না টেনে নিল, কেউ খোঁচা দিল, কেউ ধাক্কা, কেউ পথ আটকালো, কেউ বুক টিপে ধরল, হা হা হাসল, খু খু কাশল। তারপরও মনে হয়, দিনের চেয়েও রাত আরও ভয়ংকর, রাতে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে। রাত আমাকে অন্ধকার কুয়োয় জন্মের মত ডুবিয়ে দিতে পারে। বাড়ি পৌঁছে আমি নিঃশ্বাস ফেলি। প্রতিবারই বাড়ি ফিরে আসা প্রতিবারই একটি বেঁচে যাওয়া দিন। গায়নোকলজি বিভাগের রাতে ডিউটি থাকে, সারারাত। রাত আটটা থেকে সকাল আটটা অবদি। রাত আটটার ডিউটিতে আমি সন্ধে ছটায় গিয়ে বসে থাকি, অন্ধকার নামার আগে আমি চলে যাই হাসপাতালে, সময়ের পোঁছলে কোনো অসুবিধে নেই, সময়ের আগে চলে আসাই অসুবিধে। এই রাত্তিরের ক্লাস-ডিউটি আমাকে অন্ধকারের ভয় দিয়েছে বটে, কিন্তু একটি চমৎকার জিনিস দেখিয়েছে, ছায়াবাণী থেকে অজন্তা সিনেমাঘরের মাঝখানের রাস্তার কিনারে বসে কুপি জ্বেলে গ্রাম থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা চাল ডাল সবজি চিড়ে মুড়ি ইত্যাদি বিক্রি করছে। দৃশ্যটি আমাকে আলোড়িত করে, মাকে বলি ঘটনা, মা বলেন, ওদের মতও যদি হইতে পারতাম, তাইলে বাঁচতাম। আমার মনে হয় মা হয়ত ঠিক বলেন। ফুটপাতের ওই মেয়েদের যে দৃঢ়তা এবং সাহস দেখেছি তা আমি লক্ষ করি মার নেই, আমারই বা আছে কি? নারী আমাকে উদ্বুদ্ধ করে, উদ্বুদ্ধ করে কলম হাতে নিতে, দুটো শাদা কাগজ নিতে, লিখতে। আমি না লিখে পারি না।

 

বিস্তৃত এলাকা জুড়ে মেয়ে মানুষেরা আজ বেসাতি সাজায়, দেহ নয়, রূপ নয়, সমুখে তাদের পণ্য ধুলায় বিছানো, কুমড়া পটল লাউ পুঁই আর ডাঁটা শাক ক্ষেতের বেগুন, কে যেন সুদূর থেকে করুণ বেসুরো বাঁশি নিয়ত বাজায়। কারো বউ, কারো বোন,কারো বা জননী তারা, তোমরা তো জানো, ঘোমটা ফেলেছে তারা, খসিয়েছে পান থেকে সংস্কারের চুন। অভাব নেমেছে দেশে, অসুরের শক্তি দেহে বেজায় বেহায়া, বিশাল হাঙর মখু , ছিঁড়ে খায় মাটি থেকে শস্যের শিকড়, অপয়া অভাব ঘরে শুষে খায় প্রিয় খুব ভাতের সুঘ্রাণ, মারমুখো জানোয়ার দুহাতে খাবলে নেয় প্রশান্তির ছায়া, রাত থেকে নিদ্রা কেড়ে আগামীর স্বপ্ন ভেঙে পুড়িয়েছে ঘর, ভিটেমাটি সব গেছে, পোড়া দেহে শুধু কাঁদে বিকলাঙ্গ প্রাণ। অন্ধকার জীবনের দরোজায় কড়া নাড়ে আলোকিত ক্ষিদে, বিকট হাত পা মেলে বেলাজ বেঢপ ক্ষিদে নৃত্য করে খুব, গতর খাটিয়ে খেয়ে অভাগীরা তীর ছোঁড়ে ক্ষিদের শরীরে, রঙচঙ মুখে মেখে তেরঙা শাড়িতে নয়, বড় সাদাসিধে, শহরের ফুটপাতে সাহসে দাঁড়লো এসে পুণ্যবতী রূপ, সুলভে শরীর নয়, গর্বিত নারীরা বেচে দধু কলা চিড়ে।

 

নারীর জীবন আমাকে আয় আয় বলে ডাকে। নারী আমাকে ভাবাতে থাকে। নারীর দুঃখ বেদনা আমি অনুভব করতে থাকি। নিজে যে কষ্ট পেয়েছি জীবনে, সে তো নারীর কষ্টই। কেবল আমার কি! মনে হয় এ কষ্ট আরও হাজার নারীর।

 

কোমল কুমারী নারী শরমে আনত মখু বিবাহের দিন, অজানা সুখের ভয়ে নীলাভ শরীর কাঁপে কি জানি কি হয়। সানাইয়ের সুর শেষ, রাত বাড়ে, বধূটির কন্ঠ হয় ক্ষীণ, পুরুষ প্রথম এসে নিশব্দ নির্জন ঘরে কি কথা যে কয়! দেবতা নামক স্বামী লাগিয়ে দোরের খিল বক্র চোখে দেখে, লোভনীয় মাংসময় অনাঘ্রাতা বালিকার সলজ্জ শরীর। বহুদেহ বহুবার উ−ন্মাচিত করেছে সে নিষিদ্ধ পল্লীর, অভ্যস্ত হাতের কালি নারীর কপাল জুড়ে ভাগ্যখানি লেখে। অবুঝ কিশোরী মেয়ে, স্বপ্ন সাধ ভাঙে তার, দুঃখে বাঁধে বুক, এরকমই বুঝি হয়, পৃথিবীর এরকমই নিয়ম কানুন। পিশাচি উল্লাস করে নি−ষ্পষিত দেহমনে বাসনার খুন, পরম সোহাগে বধূ উপহার নিল অঙ্গে নিষিদ্ধ অসুখ । বছর পেরোলে নারী বিকলাঙ্গ শিশু এক করলো প্রসব, জটিল রোগের বিষ, আগুন জ্বালিয়ে দেহে স্বাগত জানায়! সিফিলিস রোগ নাম, রক্তের প্রপাত বেয় বসত বানায়, পেলব শুভ্রতা ছেঁড়ে, বিষাক্ত নখরে ছেঁড়ে হাড় মাংস সব। রাত্রির হিংস্রতা এসে জীবনের সূর্য খেয়ে নেভায় সকাল, দুরারোগ্য কালো পাপ অকালে নারীকে শুষে কেড়ে নেয় আয়ু। অবশ হাত পা মেলে পড়ে থাকে বোবা কালা জর্জরিত স্নায়ু আছর করেছে জীনে—এমন কথাই লোকে জানে চিরকাল।

 

আমাকে নারীতে পায়। আমাকে বেদনায় পায়।

 

মেয়েটির বাপ নেই, জমিজমা কিছু নেই, কোমল বয়স, গ্রামজুড়ে কথা ওঠে, মায়ে তাকে খুঁটি দেবে পুরোনো ঘরের। কেউ তো নেয়না মেয়ে, বাঁশির বাদকও শুনি যৌতুকের বশ, কে তবে কোথায় আছে? ভীমরতি-বুড়ো পরে পোশাক বরের। বুড়োর হাপাঁনি রোগ, চারটে সতিন ঘরে ঠ্যাং মেলে শোয়, আকুল নয়নে মেয়ে চারপাশে খোঁজে শুধু বাঁচার আশ্রয়, কোথায় বাসর ঘর, ভেঙে চুরে স্বপ্ন সব ছত্রখান হয়, নিয়তির কাছে হেরে এইভাবে হল তার যৌবনের ক্ষয়।

 

মা সে মা হোক, মা তো নারীই, মার কষ্টগুলো এই প্রথম আমি স্পর্শ করি।

 

অনেক বলেছে নারী, তাবিজ কবজ করে ফেরাতে চেয়েছে, তবু তো ফেরে না স্বামী, একেতে মেটেনা শখ, বিচিত্র স্বভাব। কোথায় মোহিনী মায়া কি জানি কেমন করে কি সুখ পেয়েছে, একেতে মেটে না শখ, বিপুল আমোদে নাচে বিলাসি নবাব। একাকিনী ঘরে নারী চোখের জলের নদী বহায়ে ভীষণ, মাজারে পয়সা ঢালে পীরের মুরিদ হয় দুনিয়া বিমখু , বুকের ভেতরে তার কষ্টের পাহাড় জমে, ছেঁড়াখোঁড়া মন, বানানো বিশ্বাস নিয়ে বিকৃত স্নায়ুরা চায় দেখানিয়া সুখ । পীরকে হাদিয়া দিয়ে, মাজারে সেজদা দিয়ে উদাসীন নারী, একালে সুখের ঘর কপালে জোটেনি বলে পরকাল খোঁজে, খোদা ও নামাজে ডুবে দিতে চায় জীবনের হাহাকার পাড়ি, বিস্বাদ জীবনে নারী অ−লৗকিক স্বপ্ন নিয়ে চক্ষু দুটি বোজে।

 

একদিন শেষ-বিকেলে সাফিনাজের সঙ্গে রিক্সা করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, গাঙ্গিনার পাড় থেকে ডানদিকে রিক্সা মোড় নিতেই ও চাপা স্বরে বলে উঠল,ওই যে দেখ প্রস্টিটিউট যায়। বল কি! আমি প্রতিবাদ করেছি। এ তো সাধারণ একটি মেয়ে। সাফিনাজ হেসেছিল শুনে। আমি এদের প্রায়ই দেখি রাস্তায়, কোনওদিন মনে হয়নি, এরা পতিতা। দরিদ্র মেয়ে, গায়ে সস্তা শাড়ি, মুখে হয়ত শখ করে আলতার রং লাগিয়েছে। এরকম শখ তো যে কোনও মেয়েরই হয়। রাস্তায় দেখা বেশ্যা নামের মেয়েটির প্রতি আমার কোনো ঘণৃা হয়নি। বরং ওর জন্য আশ্চর্য রকম মমতা জন্ম নেয় আমার।

 

তিনকূলে কেউ নেই, ডাঙর হয়েই মেয়ে টের পেয়ে যায়, অভাবের হিংস্র হাত জীবন কামড়ে ধরে ছিঁড়েখুঁড়ে খায়। যুবতী শরীর দেখে গৃহিণরা সাধ করে ডাকে না বিপদ, বেসুমার ক্ষিদে পেটে,


Rx Munna

447 Blogg inlägg

Kommentarer